নির্বাচনী প্রচারে শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় জুটি কি রাজ্য বিজেপি-তে এক আলাদা দ্বীপ? স্বশাসিত? কলকাতা জোনের পর্যবেক্ষক শোভন এবং সহ-আহ্বায়ক বৈশাখীর সাম্প্রতিক কর্মসূচি থেকে তেমন কৌতূহলই প্রকাশ করছে দলের একাংশ। সেই কৌতূহল নিরসনে রাজ্য বিজেপি-র শীর্ষনেতাদের একাংশ বলছেন, ‘‘ওটা একটা স্বশাসিত দ্বীপ। বিজেপি-র অঙ্গরাজ্যও নয়।’’ যদিও শোভন-ঘনিষ্ঠদের দাবি, ‘‘এ সব যাঁরা বলছেন তাঁরা বলুন! ওঁরা যে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেই অনুযায়ীই কাজ করছেন। সময়মতো তার ফল দেখবেন রাজ্যের মানুষ।’’
বিজেপি-তে এটা মোটামুটি এখন স্পষ্ট যে, শোভন-বৈশাখীর প্রায় সব কর্মসূচি এড়িয়ে যাচ্ছেন রাজ্য স্তরের বিভিন্ন নেতা। দীর্ঘদিন পর ‘সক্রিয়’ শোভনের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনও কর্মসূচিতে দেখা যায়নি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। পুরনো সতীর্থের সঙ্গে মিছিল, সমাবেশে এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের। গত ১৮ জানুয়ারি দক্ষিণ কলকাতায় দিলীপ-শুভেন্দুর র্যালিতে ওই জুটি থাকবেন বলে প্রচার করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা দেখা যায়নি। কিন্ত এমন কেন? শোভন-বৈশাখীও কি এমনই চাইছেন? নাকি অন্যদের ‘অনীহা’? সে বিষয়েও সে ভাবে মুখ খুলছেন না কেউ। আড়ালে খানিক লঘু রসিকতা করলেও প্রকাশ্যে সকলের মুখে কুলুপ। এরই মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে সভা করে এসেছেন শুভেন্দু ও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল বিধায়ক দীপক হালদার। সেই মঞ্চেও ছিলেন না শোভন-বৈশাখী। সে দিন বেহালায় রোড শোযে ছিলেন তাঁরা। ইদানীং কালে একমাত্র ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অনুষ্ঠানের দিন সকলের সঙ্গে তাঁদের দেখা গিয়েছিল।
যদিও দূরত্বের অভিযোগ মানতে একেবারেই রাজি নন বৈশাখী। বৃহস্পতিবার তিনি আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেন, ‘‘অন্য কোনও নেতা আমাদের সঙ্গে থাকছেন না প্রয়োজন নেই বলেই। শোভনবাবু এমন মাপের একজন নেতা, যে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে প্রয়োজন হয় না। আমি হলে দরকার হত। কিন্তু আমার সঙ্গে উনি থাকছেন। আর যে এলাকা ওঁর দায়িত্বে, সেটা ওঁর চেনা জমি। নিজের জমি।’’ বস্তুত, বৈশাখীর আরও বক্তব্য, ‘‘যাঁরা সমালোচনা করছেন তাঁরা করুন। কিন্তু দল একটা বড় এলাকার দায়িত্ব শোভনবাবুর উপর দিয়েছে। ভরসা করছে বলেই তো দিয়েছে। আর ৫১টা বিধানসভা এলাকার যে বড় দায়িত্ব, তার জন্য হাতে সময় খুবই কম। নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তার প্রস্তুতির জন্য উনি কঠোর পরিশ্রম করছেন। এতটাই যে, কলকাতা জোনের বাইরে অন্য জোন থেকে প্রচারে যাওয়ার আমন্ত্রণ এলেও আমদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর সব সমাবেশে আমাদের যাওয়ার কথাও তো নয়। বিজেপি-তে সকলের দায়িত্ব ভাগ করা থাকে। আমাদের কর্মসূচি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করছি।’’
রাজ্য নেতারা কেন একটু দূরে দূরে? এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই যোগাযোগ রেখে চলছেন। ওই নেতার দাবি, ৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ কলকাতায় শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে মিছিল করার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ভেস্তে যাওয়ায় অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে। রাজ্য দফতরে শোভন-বৈশাখীর জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করা হলেও তাঁরা আসেননি। শেষ পর্যন্ত অনেক সাধ্যসাধনায় ‘মানভঞ্জন’ হয়। ৬ ডিসেম্বর দু’জনে আসেন হেস্টিংসের নির্বাচনী কার্যালয়ে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বৈঠক করে ওঁদের ‘সক্রিয়’ হতে বলেন।
এর পরে সক্রিয় হয়েছেন শোভন-বৈশাখী। কিন্তু তাতেও পদে পদে উদ্বেগে রয়েছেন বিজেপি নেতাদের একাংশ। এক রসিক নেতার কথায়, ‘‘কোনও কর্মসূচি সম্পর্কে কে ফোনে ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, তা নিয়ে খো খো খেলা চলে। এ ওকে ঠেলে দেয়। ও তাকে। কারণ, সরাসরি সেভাবে শোভনের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা যায় না। ফোন করতে হয় বৈশাখীকে। তাতে সকলের কিন্তু কিন্তু ভাব। যদি উনি কোনও কারণে ক্ষুন্ন হন!’’ তবে ওই ধারনা কার্যত উড়িয়েই দিয়েছেন বৈশাখী। বরং তাঁর বক্তব্য, ‘‘এটা অপপ্রচার। আমাদের কর্মসূচির গোটাটাই ঠিক হচ্ছে কৈলাস’জি ও শিব প্রকাশ’জির নির্দেশমতো। তাঁরা যেমন বলছেন, তেমনটাই করছি আমরা। গত ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কলকাতায় এলে স্বাগত জানানোর জন্য দলের পক্ষে আমাদের হেলিপ্যাডে যেতে বলা হয়েছিল। আমরাও গিয়েওছিলাম।’’
রাজ্যনেতাদের একাংশ ‘দূরত্ব’ রাখলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন কলকাতা জোনের দায়িত্ব নিয়ে বাংলায় আসা উত্তরপ্রদেশ বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুনীল বনসল। গত ২৭ জানুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতায় শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে বৈঠকও করেন সুনীল। তবে কলকাতা জোনের কমিটিতে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে আরও যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁরাও খানিক দূরেই থাকছেন। দলের নির্দেশে শোভন-বৈশাখীর কোনও কর্মসূচিতে গেলেও থাকছেন ফ্রেমের বাইরে।
বিজেপি সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন কৈলাসও। গত সোমবার রাজ্য বিজেপি-র প্রস্তাবিত ‘পরিবর্তন যাত্রা’ নিয়ে বৈঠকে শোভন-বৈশাখীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর পরে বুধবার রাজ্য দফতরে রথযাত্রা নিয়ে বৈঠকও করেন তাঁরা। তবে ৩১ জানুয়ারি হাওড়ার ডুমুরজলার সমাবেশে রাজ্য বিজেপি-র প্রায় সব নেতাই উপস্থিত থাকলেও ওঁরা ছিলেন না। ডুমুরজলার ‘তারকা’ সমাবেশ থেকে অনেক দূরে কাকদ্বীপে প্রায় গোটা দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সাংগঠনিক বৈঠক করেন শোভন-বৈশাখী। তবে শোভন যে নিজের ‘কাজ’ করে চলেছেন, তা মানছেন রাজ্য বিজেপি-র শীর্ষনেতারাও। বস্তুত, তাঁরা দূরত্বের কথা প্রকাশ্যে মানতেও চাইছেন না। বলছেন, ‘‘কলকাতা জোনের সংগঠন শক্তিশালী করার কাজ ওঁরা নিজেদের মতো করে চালিয়ে যাচ্ছেন। সকলকে সবকিছুতে থাকতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই!’’
রাজ্য বিজেপি নেতারা আসলে বোঝাতে চাইছেন, আলাদা ‘দ্বীপ’ নন। শোভন-বৈশাখী পদ্মসমুদ্রে ভাসমান বিজেপি ‘দ্বীপপুঞ্জ’-এরই অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy