ক্রিকেটযুদ্ধে কোণঠাসা হয়েও সহজে হার মানেননি তিনি। স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন বার বার।
অবসরের পরেও স্রেফ বাইশ গজের পরিচয়ে আটকে থাকেননি। বাঁহাতি ক্রিকেট শৌর্যের বিশিষ্ট প্রতীক, দেশের অন্যতম সফল ক্রিকেট ক্যাপ্টেন থেকে ধারাভাষ্যকার, টিভি সঞ্চালক বা ক্রিকেট প্রশাসকের ভূমিকাতেও নিজস্ব ছাপ রেখে গিয়েছেন। সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন অবতার এ বার ‘গল্পকার’।
ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় সে-সব গল্পের কিছুমিছুর দেখা মিলতে পারে। কিন্তু নিছকই ক্রিকেটীয় গল্প নয়। যে গল্প আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষেরও গল্প। চেষ্টা করেও সব ক’টা দিন সমান না-যাওয়ার গল্প। অহেতুক পরশ্রীকাতরতা বা বসের (পড়ুন, নির্বাচকদের) অপছন্দের তালিকাভুক্ত হওয়ার গল্প। সাফল্যের চুড়ো ছুঁয়েও পর মুহূর্তে মাটিতে আছড়ে পড়ার গল্প। ফের শূন্য থেকে শুরু করার গল্প। লেখক লেখা শুরুর আগেই গল্পের বইয়ের নামও পাকা। ‘আ সেঞ্চুরি ইজ নট এনাফ!’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ১৬টি গ্রীষ্মের তাপ-উত্তাপ মাখা ক্রিকেটযোদ্ধা তথা হবু লেখকের আজকের আপ্তবাক্যও সেটাই। যিনি বলছেন, ‘‘জীবনে কোনও কিছুই রক্ষাকবচ বলা যায় না!’’ লেখক হিসেবে ইনিংস শুরুর কথা ঘোষণা করতে তাঁর নিজের শহরের ডেটলাইনটুকু নিজেই বেছে নিয়েছেন সৌরভ। তাঁর ক্রিকেটজীবনের প্রতিটি চড়াই-উতরাইয়ে যে শহর তাঁকে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। মঙ্গলবারের কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের নামী হোটেলের সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর উপলব্ধি, ‘‘ভাল কাজ, ভাল চেষ্টার পরেও অদ্ভূত ভাবে কখনও ঠেকে যেতে হয়। কিন্তু হার মানলে চলে না। এটাই জীবন। আ সেঞ্চুরি ইজ নট এনাফ।’’
এটাই সৌরভের বইয়ের নির্যাস। লর্ডসে তাঁর স্বপ্নের টেস্ট অভিষেকের পরে জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। কারও কারও মত, আত্মজীবনী লেখার এটাই মোক্ষম সময় ছিল। কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিজে তা মনে করছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘এখনও আমার জীবনের অনেক বাকি! এ বই মোটেও আত্মজীবনী নয়। নিছক স্মৃতিচারণও নয়।’’ তাঁর বইয়ের প্রকাশক জাগারনট বুক্স-এর চিকি সরকারেরও বিশ্বাস, ‘‘কেউ যখন নিজের জীবন সম্বন্ধে সব কিছু অকপটে বলার অবস্থায় আসেন, তখনই আত্মজীবনী লেখা উচিত।’’ কিন্তু সৌরভের জীবনের অন্য রসদে তাঁরা আগ্রহী। চিকির আশা, সৌরভের ক্রিকেট জীবনের লড়াইয়ের ভিতরের গল্প শুধু হবু ক্রিকেটার নয়, যে কোনও পাঠকের জীবনেই ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র হতে পারে।
চার্লস চ্যাপলিন, মহম্মদ আলি বা স্টিভ জোবসের বই পড়তে গিয়েও এমন অভিজ্ঞতা বহু পাঠকের হয়েছে। বইয়ে উঠে আসা জীবনের ছবি যখন নেহাতই আটপৌরে খুব সাধারণ পাঠকের মধ্যেও চারিয়ে তুলেছে ‘হাল ছেড়ো না’-বোধ। আত্মজীবনীর আদলে যা আদতে উদ্দীপনার কড়া টনিক হয়ে অনেককেই পথ দেখিয়েছে। প্রকাশকরা চান, আত্মজীবনীর খুঁটিনাটিতে না-ঢুকেও সৌরভের বই পাখির চোখের মতো তাঁর ক্রিকেটীয় যুদ্ধজয়ের রসায়নটুকু নিংড়ে আনবে।
ভারতীয় ক্রিকেটের অবিসংবাদিত দাদা নিজেও জানেন, তাঁর ক্রিকেট-জীবন নিছকই রূপকথার ইচ্ছাপূরণ ছিল না! তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো সচিন তেণ্ডুলকর ছিলাম না। সচিনের মতো অসামান্য প্রতিভা নই, তাই সচিনের মতো আলাদা হওয়ার অ্যাডভান্টেজও ছিল না।’’ তাই ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়র, দুনিয়ার নানা প্রান্তে ক্রিকেটের নানা কিসিমের আঙ্গিকে ধাতস্থ হওয়া মানুষ হিসেবেও তাঁকে গড়েপিটে নিয়েছে বলেই মনে করেন সৌরভ।
ক্রিকেটবোদ্ধা থেকে সমকালের আম-ভারতীয়— সকলেই মানেন, এমন উৎকর্ষের চুড়ো ছোঁয়া সাফল্য ও নাটকীয় ব্যর্থতার মিশেল সৌরভ ছাড়া আর কোথায়! এমন প্রতিকূলতার উজান ঠেলা হার না-মানা জেদের প্যাকেজও বিরল। যিনি এ দিনও বলেছেন, ‘‘আমি উত্থান-পতনে বিশ্বাসী নই। লড়াইটাই আসল।’’ এ দেশের পাঠকদের জন্য বেশ কিছু দিন ধরে এমনই মলাট-বন্দি প্রেরণা খুঁজছিল জাগারনট বুকস। আর সেটাই লেখক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ইনিংসের পথ খুলে দিল।
হাজারো ব্যস্ততায় নিয়ম করে ধরেবেঁধে লিখতে বসা খুব সোজা কাজ নয় তাঁর জন্য। তবু নিজের লড়াইয়ের গল্প ভাগ করে নিতে রাজি হয়েছেন সৌরভ। প্রকাশকদের আশা, মোবাইলের অ্যাপ থেকে মুদ্রিত সংস্করণে, সেই ‘দাদার কীর্তি’ এক বছরের মধ্যেই সাকার হতে পারবে।
ঘটনাচক্রে এখনই দেশের হবু ক্রিকেট কোচ বাছাইয়ের দায়িত্বও দাদার কাঁধে। যা আর এক দগদগে স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। এক যুগ আগে ইন্টারভিউ নিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে বাছাইও তিনিই করেছিলেন। যার পরিণাম সৌরভের জন্য খুব সুখকর হয়নি। সে-দিনও সাফল্যের শিখর থেকে এক ধাক্কায় ব্যর্থতার তলানিতে নেমে আসতে হয়েছিল তাঁকে। সদ্য বিদেশে সেঞ্চুরি হাঁকানো, টেস্ট সিরিজ জেতানো ক্যাপ্টেন রাতারাতি টিম থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন। তাঁর বইয়ের মধ্যে জীবনের সেই নাটকীয় মোচড়টিকেও এখন উদ্যাপন করতে চলেছেন সৌরভ। ‘আ সেঞ্চুরি ইজনট এনাফ’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy