অমিত শাহকে স্বাগত জানাচ্ছেন সজল ঘোষ। রয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদার। —নিজস্ব চিত্র।
ছেড়ে আসা দলে তাঁর অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী। বিজেপিতেও কম নয়। তবুও সজল ঘোষ জিতলেন। কলকাতা পুরসভায় তিনিই পদ্ম শিবিরের একমাত্র জয়ী প্রার্থী, যিনি তৃণমূলের হাত থেকে ওয়ার্ড ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্গাপুজো উদ্বোধনের আলো কাড়ার লড়াইয়ে তিনি দ্বিতীয়াতেই এগিয়ে রইলেন। এক মাত্র তাঁর পুজো উদ্বোধন করতেই দিল্লি থেকে কলকাতায় এলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ!
একটা সময়ে প্রদীপ ঘোষের পুজো হিসাবেই বিখ্যাত ছিল সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। যে পুজোর ডাক নাম ‘লেবুতলা পার্ক’। উত্তরাধিকার সূত্রে সেই পুজো এখন প্রদীপ-পুত্র সজলের। দ্বিতীয়ার বিকেলে সেই পুজোর উদ্বোধন করলেন শাহ। দিল্লি থেকে কলকাতা বিমানবন্দর, সেখান থেকে হেলিকপ্টারে রেসকোর্স, সেখান থেকে সড়কপথে সজলের মণ্ডপ হয়ে আবার দিল্লি প্রত্যাবর্তন। মাত্র একটিই পুজোর জন্য শাহের এত আয়োজন! বিজেপির অন্য কোনও নেতার এমন ‘সৌভাগ্য’ হয়নি। দলের এক কাউন্সিলারের ‘অতিথি’ হয়েই মঞ্চে শাহের পাশে রইলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, দলের নেতা। দলের অন্দরে এটা ‘জয়’ তো বটেই। মানছেন বিজেপি নেতাদের একটা অংশও।
তবে অন্য বক্তব্যও রয়েছে। দলের অন্য একটি অংশের কথায়, সজলের পুজো ছাড়া কলকাতায় বিজেপির আর একটি বড় পুজোও নেই। আসতে হলে শাহকে সেখানেই আসতে হত। তিনি তা-ই এসেছেন। রাজ্য বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা যেমন বললেন, ‘‘কলকাতা শহরে আমাদের তো আর কোনও বড় পুজো নেই। একমাত্র সজলের পুজোই আমাদের। বাকি সবই তো তৃণমূলের! আর কলকাতার পুজো উদ্বোধনে না-এলে নজর কাড়া যাবে কী করে! সেই জন্যই অমিতজি সজলের পুজোয় এসেছেন।’’
তবে শাহকে নিজের পুজোয় নিয়ে আসতে পারার লড়াই ছোটখাট ছিল না সজলের কাছে। ২০২২ সালের পুজোর আগে থেকেই সেই চেষ্টা শুরু হয়েছিল। শাহ যাতে আকৃষ্ট হন, সে জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনা মিলিয়ে পুজোর থিম করেছিলেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর। কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও শাহকে আনতে পারেননি সজল। তখন থেকেই ২০২৩ সালের প্রস্তুতি শুরু করে দেন তিনি। ৮৭তম বছরে মণ্ডপ অযোধ্যার প্রস্তাবিত রামমন্দিরের অনুকরণে। তার উদ্বোধনে শাহ।
তবে সেটাও নাকি সহজ ছিল না। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি যে ‘পরিপক্ক’ সে পরিচয় ইতিমধ্যেই দিয়েছেন সজল। এ বার দেখালেন, কোন রাস্তায় কাকে ধরে এগোলে সফল হওয়া যায়, সেটাও তিনি জানেন।
গত বৃহস্পতিবার রাজ্য সভাপতি সুকান্ত জানিয়ে দেন, অনেক চেষ্টা হলেও শাহকে রাজ্যে কোনও পুজোর উদ্বোধনে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে তিনি ব্যস্ত। তবে ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় আসবেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা। উদ্বোধন নয়, ঠাকুর দেখতে যাবেন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে। সেদিন দুপুর পর্যন্ত সজলও তাই জানতেন। সেদিনই তাঁর মণ্ডপে প্রতিমা আসার কথা। তার তোড়জোড়ের মধ্যেই সজলের কাছে বিকেল সওয়া ৩টে নাগাদ খবর আসে, তাঁর পুজোর উদ্বোধন করবেন শাহ। দ্বিতীয়ার দিন বিকেলে। সে খবর প্রকাশ্যে আসার পরে সজল বলেছিলেন, ‘‘পাকা খবর পেয়ে গিয়েছি। কোনও ভার্চুয়াল উদ্বোধন নয়। সশরীরে।’’ তখন তাঁর গলায় জিতে যাওয়ার উচ্ছ্বাস। বিজেপি সূত্রের খবর, গোটা বিষয়টা পাকা হয়েছিল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে’। রাজ্য বিজেপির অন্দরের সমীকরণে সজল যাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত।
বিজেপির একটি অংশ মনে করে, যে রাজ্যে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ৩৫ আসন পাওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন (এবং দিয়েছেন) শাহ, সেই বাংলার প্রধান উৎসবে তিনিও নিশ্চয়ই আসতে চাইবেন। তবে এমন কোনও পুজো চাইবেন, যা ধারে-ভারে তাঁর উপযুক্ত। সেই হিসাবে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার সঠিক বাছাই। এর আগে ২০১৯ সালে কলকাতার পুজোয় এলেও শাহ উদ্বোধন করেছিলেন সল্টলেকের বিজে ব্লকের পুজো। সেটা প্রথমত খাস কলকাতায় নয়। আর তেমন নামী পুজোও নয়। এ বার শাহ মূল কলকাতা শহরের একটি পুজোর উদ্বোধনে অংশ নিলেন। বিজেপির ওই অংশের দাবি, সজল নন, শাহকে নিয়ে এসেছে লেবুতলা পার্কের পুজোর ‘ভার’।
শহরের বাইরে থেকে কলকাতায় যাঁরা পুজো দেখতে আসেন, তাঁরা শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে এলে প্রথম লক্ষ্য থাকে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার। ভিআইপি রোডের ধারে শ্রীভূমি, দক্ষিণ কলকাতার চেতলা অগ্রণী বা সুরুচি সঙ্ঘের সঙ্গে নিঃসন্দেহে পাল্লা দিতে পারে এই পুজো।
এখন আর দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় পার্বণ নয়। সর্বজনীন এই উৎসব রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনেরও। কলকাতা শহরের প্রধান পুজোগুলির উদ্যোক্তারা অনেকেই মন্ত্রী। এ ছাড়াও তৃণমূলের পুরপ্রতিনিধি থেকে বিধায়ক এবং নেতাদের পুজো রয়েছে। জাঁকজমকের নিরিখে সকলেই একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে। তার মধ্যে বিজেপি-র ‘একা কুম্ভ’ সজল। তাঁর পিতা প্রদীপ এক সময়ের দাপুটে কংগ্রেস নেতা। পরে পিতা-পুত্র দু’জনেই তৃণমূল করেছেন। এখন তাঁরা গেরুয়া শিবিরে। প্রদীপ এখন আর সে ভাবে রাজনীতির সঙ্গে আর যুক্ত না থাকলেও সজল বিজেপির কাউন্সিলর ছাড়াও দলের কলকাতা বিভাগের ‘আহ্বায়ক’। সেই দায়িত্ব খুব বড় কিছু না হলেও রাজনীতিক হিসাবে তিনি গেরুয়া শিবিরে গুরুত্ব পান। যা সোমবারের পর বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত বিধানসভা ভোটের আগে আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন সজল। প্রথমে মনে করা হয়েছিল তিনি চৌরঙ্গি বিধানসভা আসনে প্রার্থী হবেন। তা হয়নি। তবে গেরুয়া রাজনীতিতে নতুন করে খ্যাত হয়ে যান ভোটের পরে একটি গোলমালের অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে। ২০২১ সালের ১২ অগস্ট মুচিপাড়া থানা এলাকায় একটি গোলমালে উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে পরের দিন পুলিশকর্মীরা সজলের বাড়িতে হাজির হন। মুচিপাড়া থানার ওসি জানলা দিয়ে সজলকে বাড়ির বাইরে আসার কথা বললেও তিনি রাজি হননি। উল্টে তিনি পুলিশের উদ্দেশে বলেন, ‘‘দরজা ভাঙুন!’’ এর পর পুলিশকর্মীরা বাড়ির দরজা ভেঙে সজলকে থানায় নিয়ে যান। সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারের পুজোর পার্কের সামনে দিয়েই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে।
সেই পুজোর মণ্ডপে দাঁড়িয়েই সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনকে সজল বললেন, ‘‘মা দুর্গার আশীর্বাদেই সব হয়েছে। আমরা কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেই। দর্শক টানায় আমরা চিরকাল এক নম্বরে ছিলাম, আছি, থাকব।’’
দর্শক তো বটেই, রাজ্য বিজেপি দেখল, ‘অমিত-টানেও’ সজলই এক নম্বরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy