জল-যোগ: পলি পড়ে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হচ্ছে গঙ্গাবক্ষ। ফলে ভবিষ্যতে শহরে জলসঙ্কটের আশঙ্কাও বাড়ছে। বুধবার, প্রিন্সেপ ঘাটে। নিজস্ব চিত্র
‘‘গঙ্গা তো রয়েছেই। ফলে সেখান থেকে প্রয়োজন মতো জল তুলে পরিশোধনের পরে সরবরাহ করে থাকে কলকাতা পুরসভা। তাই জলসঙ্কট কী, এখনও বুঝতে পারছে না শহর।’’ বলছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের এক অধ্যাপক।
পলতা, গার্ডেনরিচ, ধাপা, জোড়াবাগান এবং ওয়াটগঞ্জ, এই পাঁচটি জলপ্রকল্পের মাধ্যমে পুরসভার দৈনিক সরবরাহ করা প্রায় ২০২ কোটি ৭৫ লক্ষ লিটার পরিস্রুত জলের প্রধান উৎসই গঙ্গা। যদিও নদী-বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন, ফেয়ারলি ঘাট থেকে হাওড়ার ফেরি পারাপার ঘাটের মধ্যবর্তী গঙ্গার প্রস্থ ২০০৪ সালে ১৭৩২ ফুট ছিল। ২০১৯ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৯৯ ফুটে। অর্থাৎ, গত ১৫ বছরে গঙ্গার চওড়া কমেছে ১৩৩ ফুট! সুপ্রতিমবাবুর কথায়, ‘‘১৫ বছরে ১৩৩ ফুট, মানে বছরে গড়ে আট ফুট করে প্রস্থ কমা যথেষ্ট উদ্বেগের।’’ ফলে ভবিষ্যতে গঙ্গার স্রোত আরও কমলে শহরের পানীয় জলের চিত্র কী হতে পারে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সব মহল। ‘কলকাতা এনভায়রনমেন্ট ইম্প্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর (কেইআইআইপি)
‘রোডম্যাপ’ এবং কলকাতা পুরসভার জল অপচয় কমানোর ‘অ্যাকশন প্ল্যান: ২০১৫-২০২০ সাল’-এর তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে সরবরাহ করা জলের পরিমাণ হওয়ার কথা প্রায় ১২৪ কোটি ৫০ লক্ষ লিটার। যার মধ্যে রয়েছে শহরের ৪৫ লক্ষ জনসংখ্যার দৈনিক মাথাপিছু ১৫০ লিটার (‘দ্য সেন্ট্রাল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশন’-এর নির্ধারিত মাত্রা), নিত্য শহরে আসা প্রায় ৬০ লক্ষ জনসংখ্যার দৈনিক মাথাপিছু ৪০ লিটার, প্রতিবেশী পুরসভা ও বাণিজ্যিক-শিল্পক্ষেত্রে সরবরাহ করা জল। অথচ প্রতিদিন সরবরাহ হয় ২০২ কোটি ৭৫ লক্ষ লিটার। ফলে রোজ ৭৮ কোটি ২৫ লক্ষ লিটার (৩৮ শতাংশই) জল উদ্বৃত্ত থাকছে বা অপচয় হচ্ছে। জল অপচয়ের তথ্য ১-৬ নম্বর ওয়ার্ডের ‘ওয়াটার লস ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্পেও ধরা পড়েছে। জল
সরবরাহ ও খরচ হওয়া জলের হিসেব পেতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের অর্থানুকূল্যে ওই প্রকল্পে বাড়ির পাশাপাশি রাস্তার কলেও জলের মিটার বসানো হয়েছে। যদিও এই মিটার বসেছে শহরের সামান্য সংখ্যক সংযোগে। ‘ডিরেক্টরেট অব সেনসাস অপারেশনস ওয়েস্ট বেঙ্গল’ প্রকাশিত ‘ডিস্ট্রিক্ট সেনসাস হ্যান্ডবুক, কলকাতা’ অনুযায়ী, ২০১১ সালে কলকাতায় বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লক্ষ। সেখানে এখনও পর্যন্ত বাড়ি ও রাস্তার কল মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারটি মিটার বসানো হয়েছে। অর্থাৎ, মিটার বসানোর হার ০.৫ শতাংশ!
এ দিকে, এডিবি-র রিপোর্টে ধরা পড়েছে ভবিষ্যতে জলের চাহিদা বৃদ্ধির আভাস। ২০১১ সালে বসতি বাড়ি, শহরের বহুতলগুলি (যেখানে ‘বাল্ক কানেকশন’ অর্থাৎ একাধিক সংযোগের জন্য মিটার বসানো হয়) এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্র-সহ জলের সংযোগকারী লাইনের সংখ্যা প্রায় আড়াই লক্ষ ছিল। ২০২২ সালে তা বেড়ে হতে পারে প্রায় পাঁচ লক্ষ।
আবার কেইআইআইপি-র ‘রোড-ম্যাপ’ বলছে, পানীয় জল সরবরাহকারী পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য বর্তমানে ৫৮৪০ কিলোমিটার। শহরের ৯২ শতাংশ এলাকায় পাইপলাইন রয়েছে। তার পরেও প্রধান সমস্যা সরবরাহ হওয়া জলের পরিমাণে তফাত। যেমন, জলাধার সংলগ্ন ‘জল-বর্ধিষ্ণু’ এলাকায় বাসিন্দারা মাথাপিছু দৈনিক ৬০০ লিটার এবং জলসঙ্কট এলাকায় দৈনিক মাথাপিছু মাত্র ৪০ লিটার জল পান!
ফলে সরবরাহের বৈষম্য, অনিয়ন্ত্রিত খরচ, সেই সঙ্গে গঙ্গার চওড়ায় কমে আসা— সব কিছুই ভবিষ্যতে পানীয় জলসঙ্কটের দিকে নির্দেশ করছে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। এই পরিস্থিতিতে আজ, বৃহস্পতিবারই পলতা জলপ্রকল্পে দৈনিক আরও ৯ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পরিশোধন প্লান্টের উদ্বোধন করবে পুরসভা। কিন্তু এ সবই ভোট রাজনীতির কথা মাথায় রেখে সমস্যার সাময়িক সমাধান, বলছেন নদী-বিজ্ঞানীরা। এক নদী বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘গঙ্গার দুরবস্থা বোঝার জন্য কানপুর, বিহারে যাওয়ার দরকার নেই। প্রাচীন কলকাতার মানচিত্রে আদিগঙ্গার গতিপথ দেখা গিয়েছিল। তখন কি বোঝা গিয়েছিল, যে আজকের সময়ে এসে প্রায় হারিয়ে যাবে আদিগঙ্গা?’’
আর এক গবেষকের কথায়, ‘‘নতুন পরিশোধন প্লান্ট তৈরি করে বা ক্যাপসুল বুস্টার পাম্পিং স্টেশন করে এলাকাভিত্তিক পানীয় জলের সরবরাহ বাড়াতে চাইছে পুরসভা। এই উদ্যোগ স্বাগত। কিন্তু এটাও সাময়িক সমাধান, সুস্থায়ী উন্নয়নের (সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট) শর্ত নয়। অপচয়ে লাগাম না টানলে জলসঙ্কটের বিপদ এড়ানো যাবে না।’’ গবেষক-বিজ্ঞানীদের এ-ও বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে সচেতনতার প্রচারে কাজ হবে না। তাঁদের কথায়, ‘‘সব ক্ষেত্রে যদি তাতেই কাজ হত, তা হলে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বা আইনের প্রয়োজন হত না!’’
তাঁরা এ-ও জানাচ্ছেন, রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের জল-কর না বসানোর ঘোষিত নীতি বজায় রেখেই সমাধান সম্ভব। সেটি হল, মাথাপিছু দৈনিক ১৫০ লিটার জল বিনামূল্যে দিয়ে তার অতিরিক্ত জলের জন্য লিটার পিছু জরিমানা ধার্য করা। এ জন্য অপচয় হওয়া জলের হিসেব পেতে শহরের প্রতিটি বাড়িতে মিটার বসানো বাধ্যতামূলক হোক। জরিমানার অর্থও এমন করতে হবে, যাতে জল অপচয়ের আগে বাসিন্দারা ভাবেন। না-হলে আগামী প্রজন্মকে জলসঙ্কট থেকে বাঁচানো যাবে না বলেই নিশ্চিত বিশেষজ্ঞেরা।
কিন্তু রাজনীতির ঘোলা জলে পানীয় জলের অবশ্যম্ভাবী সঙ্কটের বিষয়টি হারিয়ে যাবে না তো?— আশঙ্কা সকলেরই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy