মানিকতলা এলাকার হেলে পড়া বাড়ি। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
কোথাও একটি বহুতলের স্তম্ভ ঠেলে ঢুকে এসেছে পাশের বহুতলের কার্নিস। কোথাও পাশাপাশি দুই বহুতলের মাথায় ঠোকাঠুকিতে ভেঙে গিয়েছে দেওয়াল। কোথাও আবার বহুতলের দেওয়াল জুড়ে ফাটল ধরেছে। তার কারণ, ওই বাড়ির গায়েই হেলে রয়েছে পাশের বাড়ি। কিন্তু দিনের পর দিন এমন বাড়িতে বসবাস করলেও হুঁশ হয় না বাসিন্দাদের। নেতাজিনগরের বহুতল পাশের বাড়ির উপরে হেলে পড়ার ঘটনায় এই মুহূর্তে শোরগোল চলছে। কিন্তু এমন বিপদ তো তাঁদেরও হতে পারে, এটা ভেবেও অনেকের হেলদোল নেই। মানিকতলার এমনই একটি হেলা বাড়ির বাসিন্দা বললেন, ‘‘মৃত্যু হওয়ার থাকলে চাপা পড়ে মরব। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই।’’
গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে কলকাতা পুরসভা খোঁজখবর শুরু করলে সামনে আসে মানিকতলার এই বহুতল। খালের ধারে ক্যানাল ইস্ট রোডধরে বিপ্লবী বারীন ঘোষ সরণির ৪৬/সি/২৯ নম্বর ওই বহুতলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, সেটি হেলে রয়েছে ডান দিকে। সদর দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলে হেলে যাওয়া দিকেই টান অনুভূত হয়। বাড়ির একতলার ঘর তালাবন্ধ। দোতলায় থাকেন এক অসুস্থ মহিলা। তেতলার বাসিন্দা দীপালি চক্রবর্তী জানান, ২০০১ সালে তাঁরা এই বাড়িতে ফ্ল্যাট কেনেন। ২০০২ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন। তাঁর দাবি, কয়েক বছর আগে কাছেই একটি জমিতে বহুতল নির্মাণ শুরু হতে ধীরে ধীরে তাঁদেরবাড়ি হেলতে শুরু করে। এখানেই এমন অনেক বাড়ি রয়েছে, যা কোনও না কোনও দিকে হেলে গিয়েছে বলে তাঁর দাবি।
নতুন বহুতল পরিদর্শনে এসে পুরসভার লোকজনের নজরে পড়ে হেলে পড়া এই বহুতলটি। যন্ত্র দিয়ে বাড়ি সোজা করার পরামর্শও দেওয়া হয় পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারদের তরফে। কিন্তু সেই কাজের কিছুই হয়নি। এখন সেই বাড়িই আঁকড়ে আছে অন্তত ছ’টি পরিবার। ভয় হয় না? দীপালি বললেন, ‘‘নেতাজিনগরের ঘটনা শুনেছি। হেলা বাড়ি টেনে সোজা করতে গিয়েই তো বিপদ ঘটল!’’উত্তেজিত ভাবে তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি ছাড়ার উপায় নেই আমাদের। মরতে হলে চাপা পড়ে মরব। কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।’’
একই প্রতিক্রিয়া গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বহুতলের আশপাশের বেশ কয়েকটি হেলা বাড়ির বাসিন্দাদেরও। চোখের সামনে ১৩ জনের মৃত্যু দেখেও বিপজ্জনক ঠিকানা ছাড়েননি তাঁরা। গার্ডেনরিচের ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের হরিবাবু পল্লি রোড, আজহার মোল্লা বাগান লেনে ঘুরতে ঘুরতে এমন বহু বাড়ি চোখে পড়ে, যার একটি অন্যটির দিকে হেলে রয়েছে। দেখা যায়, দুই বহুতলের মধ্যের পাঁচ ফুটের দূরত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে মাথার দিকে। এক ছাদ থেকে আর এক ছাদে অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। কার্যত এক বহুতলের ঘরের গায়ে নিঃশ্বাস ফেলে বাস করছেন অন্য বহুতলের বাসিন্দারা।
এমনই একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম ওরফে ওয়াসি। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। ওয়াসির ভাই মহম্মদ জ়াহির বললেন, ‘‘এ শহরে থাকার জায়গার অভাব। হাজার হাজার মানুষ টালির ঘরে, রাস্তায় থাকার বদলে পাকা বাড়িতে থাকতে চান। হেলা বাড়ি হলেও বাড়ি তো। বিপদ বুঝলে প্রোমোটারই বাড়ি ফাঁকা করিয়ে দেন।’’
কিন্তু এমন বাড়ি ভাঙানো নিয়েই প্রোমোটার ও তার দলবলের দাদাগিরি দেখেছে কলকাতা। তিলজলার শিবতলা লেনে ১২/১১ নম্বর পাঁচতলা একটি বাড়ি কয়েক মাস ধরে হেলে ছিল পাশের ১২/১২ নম্বর বাড়ির গায়ে। ওই বাড়ির এক বাসিন্দা প্রতিবাদ করায় পুরসভা বাড়িটি ফাঁকা করিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৯ সালে এ নিয়ে শোরগোল হয়। প্রোমোটারের দলবল এলাকা ঘিরে রাখায় টানা তিন সপ্তাহ পুরসভার লোকজন গিয়ে বাড়ি ভাঙার কাজে হাত দিতে পারেননি। শেষে সেই বাড়ি ভাঙা হলেও সেখানকার বাসিন্দা সুধীর সিংহ বলেন, ‘‘ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা ছিল না। হেলা বাড়িতেই ভাল ছিলাম। বাড়ি ভাঙানোয় ৩২টা পরিবার রাতারাতি ঘরছাড়া হল।’’
নেতাজিনগরের ঘটনার প্রেক্ষিতে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বুধবার যদিও বলেছেন, ‘‘কাউকে ঘরছাড়া করার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। কিন্তু দয়া করে কেউ বেআইনি কিছু করবেন না।’’ কিন্তু সেই অনুরোধে কাজ হবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy