জল-কথা: পাঁচটি ধাপের মধ্যে শেষ হয়েছে চারটি ধাপের কাজ। শনিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
সব মিলিয়ে সংস্কার পর্বের পাঁচটি ধাপ। সেই ‘প্রতিটি ধাপের কাজের পরে মূল কাঠামোয় কোনও রকমের বিচ্যুতি ও ভরের পরিবর্তনকে নথিভুক্ত করা ও তার উপরে নজরদারি চালানো প্রয়োজন (অ্যাট এভরি স্টেপ ডিফ্লেকশন অ্যান্ড স্ট্রেসেস শুড বি রেকর্ডেড অ্যান্ড মনিটর্ড)’। সংস্কারের কাজ শুরুর প্রাক্-পরিদর্শনে গিয়ে ২০১৩ সালের অগস্টে টালা ট্যাঙ্ক সম্পর্কে এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন খড়্গপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’-র প্রতিনিধি। সেই পরিদর্শনে খড়্গপুর আইআইটি ছাড়াও শিবপুর আইআইইএসটি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। এর পর থেকে গত তিন বছর ধরে নথিভুক্ত (রেকর্ডেড) এবং নজরদারির (মনিটর্ড) সূত্র মেনেই টালা ট্যাঙ্কের সংস্কার হয়ে এসেছে।
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, শতাব্দী-প্রাচীন এই ট্যাঙ্কের সংস্কার পর্বের চারটি ধাপ, অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত সংস্কারের ৮৫ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। যে কাজ এ বার ‘ক্রিটিক্যাল’ পর্বে প্রবেশ করতে চলেছে। তবে সেই পর্ব শুরুর আগে ছ’মাস সমস্ত কাজ বন্ধের সুপারিশ করেছেন প্রকল্পের প্রধান পরামর্শদাতা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞেরা। ওই সংস্কার প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান গোকুল মণ্ডল জানাচ্ছেন, এখনও পর্যন্ত হওয়া কাজের মূল্যায়নের জন্য ওই বিরতির প্রয়োজন। নির্ধারিত ওই সময়সীমার মধ্যে সংস্কারের জন্য যে সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে, সেগুলিতে কোনও ‘ফাঁক’ বা ট্যাঙ্কের মূল কাঠামোর (স্কেলেটাল স্ট্রাকচার) কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা দেখা হবে। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। তা হল, সংস্কারের পরিকল্পনায় ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় বা অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়টিও হিসেবে রাখা হয়েছিল। গোকুলবাবুর কথায়, ‘‘সে দিক থেকে বলা যায়, আমপান পরীক্ষায় আমরা পাশ করে গিয়েছি। কারণ, সংস্কার চলাকালীন ওই ঘূর্ণিঝড় হওয়া সত্ত্বেও কাঠামোয় তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি।’’
তা হলেও কেন পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ছে?
এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, টালা ট্যাঙ্ক তৈরির সময়ের (১৯০৭-’১১) নির্মাণ ইতিহাস বলছে, উপকরণ হিসেবে লোহার পরিবর্তে তখন সবে ইস্পাতের (স্টিল) ব্যবহার শুরু হয়েছে। সে সময়ে লোকুমখে ইস্পাতকে ‘সিলিকা স্টিল’ও (অপরিশোধিত ইস্পাত) বলা হত, যা এখনকার মতো কার্বন বা ‘মাইল্ড’ ইস্পাত নয়। ফলে তার একশো বছরেরও বেশি সময় পরে সংস্কার পর্বে ব্যবহৃত হওয়া উপকরণের সঙ্গে ট্যাঙ্কের মূল কাঠামোর ইস্পাতের আচরণগত ব্যবহার কী হবে, সে সম্পর্কে প্রাক্-ধারণা ছিল না কারওরই। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ‘ভিজ়িটিং ফ্যাকাল্টি’ বিশ্বজিৎ সোম জানাচ্ছেন, ইস্পাতে ঝালাইয়ের কাজ চলার সময়ে বিশেষ ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও ইস্পাতের মধ্যে যত কম সম্ভব হাইড্রোজেন প্রবেশের ক্ষেত্রে (লো হাইড্রোজেন ইলেকট্রোড) নজর দেওয়া হয়েছিল। কারণ, ঝালাই করা ইস্পাতের মধ্যে বেশি মাত্রার হাইড্রোজেন প্রবেশ করলে তা ভিতর থেকে চাপ সৃষ্টি করে। নির্মাণবিদ্যার সূত্র বলছে, সেই চাপ যদি ঝালাই করা ইস্পাতের ধারণ ক্ষমতার বেশি হয়ে যায়, তখনই ফাটল শুরু হয়। বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘ফলে সে দিক থেকেও মনিটরিং পর্ব ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’’
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। সেটি হল, সংস্কার চলাকালীন এক দিনও শহরে জল সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেনি, যা আক্ষরিক অর্থেই ‘বিরল’। অবশ্য কোনও কারণে মেরামতির প্রয়োজন হলেও জল সরবরাহ যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তাই ব্রিটিশরা টালা ট্যাঙ্কের ভিতরে চারটি প্রকোষ্ঠ (কম্পার্টমেন্ট) তৈরি করেছিল। যাতে প্রয়োজন মতো একটি করে প্রকোষ্ঠ বন্ধ রেখে সংস্কার করা হলেও বাকিগুলি থেকে জল সরবরাহ করা যায়। তবুও প্রায় ৪ কোটি লিটার জলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাঙ্কের সংস্কার কার্যত ‘হাই রিস্ক অ্যাক্টিভিটি’ ছিল বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
তবে চূড়ান্ত পর্বের কাজের আগে আপাতত সাময়িক ‘বিরতি’। যাতে কমপক্ষে আরও অর্ধ শতাব্দী ধরে জল সরবরাহ করে যেতে পারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ‘ওভারহেড’ ট্যাঙ্ক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy