আপ্যায়ন: পুজো শেষে জলখাবার পরিবেশনের তোড়জোড়। রবিবার, দক্ষিণ কলকাতায়। নিজস্ব চিত্র
ঘন চালের পায়েসটা দু’বার চেয়ে নিলেন পাড়ার পুজোর প্রিয়জন, সদ্যপ্রয়াত ‘বাবলুদা’র স্ত্রী শ্যামলী আদিত্য। শ্যামলীদেবী, ননদ সত্যবতী, রঞ্জিতা চট্টোপাধ্যায়রা তারিয়ে তারিয়ে পায়েসটা খেলেন রবিবার দুপুরে।
তার পরে পায়েসের আয়োজক মুদার পাথেরিয়াকে ঘিরে ধরে একযোগে প্রশস্তির ছড়াছড়ি: ‘‘একদম বাড়ির মতো হয়েছে পায়েসটা, দা-রুণ! আজকাল তো ঘরে-ঘরে ডায়াবিটিস! মিষ্টিটা একেবারে ঠিকঠাক হয়েছে।’’ লেক টেম্পল রোডে কলকাতার আদি যুগের স্মৃতি-জড়িত পুরনো মন্দির চত্বরেই নামী সর্বজনীন পুজো। বিজ্ঞাপন তথা জনসংযোগ বিশারদ মুদার থাকেন ঠিক পিছনের রাস্তায়। তাঁর বাড়িতেই তৈরি হয়েছে পায়েস। পাড়ার গর্ব, শহরের নামী সর্বজনীন পুজোর খুঁটিপুজোর সকালটা অমন ‘সাত্ত্বিক’ পায়েসের মহিমাতেই যেন আলাদা মাহাত্ম্য পেল।
মন্দিরের সামনে পুজোমণ্ডপের স্থলে খুঁটিপুজোর যাবতীয় উপচার। মন্দিরের ভিতরে দোতলার ঘরে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। পাড়ার ছেলে মুদার ছাড়া পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা জিশন মজিদ, রেহান ওয়ারসি বা কলুটোলার জুলফিকার নিয়াজ়িদের মতো কয়েক জনের উদ্যোগেই ১৫০ জনের জলখাবার। ওঁরা নিজেরাই কোমর বেঁধে পরিবেশনে তৈরি। প্রবীণ পুজোকর্তা পার্থ ঘোষ বলছিলেন, ‘‘মুদার প্রতি বারই পুজোর সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে থাকেন। এ বার ওঁরাই চাইলেন, সব খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ওঁরা করবেন। আমরা পরিবেশনের লোক রাখতে চেয়েছিলাম। ওঁরা তাতেও রাজি হলেন না!’’ মুদারের কথায়, ‘‘শুধু কেনা খাবার এত জনকে খাওয়াব, কেমন কিন্তু-কিন্তু ঠেকছিল। কপাল ঠুকে আমাদের বাড়ির রাঁধুনি রমেশ মুখিয়াকে পায়েস করতে বললাম। তিনি বিহারি, কিন্তু দেখছি পায়েসে ডিসটিংশন পেয়ে পাশ করেছেন।’’
কলকাতার পুজো-ইদে হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে উদ্যাপন নতুন নয়। শহরের বেশ কিছু এলাকার পুজোতেই কর্মকর্তাদের মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর নাম মেলে। তাঁরা আবার পুজোর ব্যাপারে ভয়ানক ‘সিরিয়াস’! কেউ কেউ পুজোর ক’দিন খাওয়াদাওয়ার নানা নিয়ম মানেন। কোনও আচারে চট করে নড়চড় হতে দেন না। আবার একই মাঠে ইদের নমাজ এবং পুজো হচ্ছে, এমন নমুনাও রয়েছে। পার্ক সার্কাসের ব্যবসায়ী তথা তরুণ সমাজকর্মী জিশান বলছিলেন, ‘‘দুর্গাপুজো কলকাতার সব থেকে বড় উৎসব। খুব ইচ্ছে করত কোনও পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে কিছু একটা করি। সেই সাধ কিছুটা মিটল।’’ ছোটবেলা উত্তর কলকাতায় কেটেছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার কর্তা রেহানেরও। ‘‘কলেজ স্কোয়ার-মহম্মদ আলি পার্কের পুজো আমার কাছে শৈশবের আনন্দ। এখনও ম্যাডক্স স্কোয়ার-একডালিয়ায় সময় কাটাতে ভাল লাগে’’— বলছেন তিনি।
কয়েক সপ্তাহ আগেই এ রাজ্যে ‘মুসলিম তোষণ’-এর ধারণাটি ভাঙতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন কলকাতার মুসলিম সমাজভুক্ত কয়েক জন পুরনো বাসিন্দা। পুজোয় লোক খাওয়ানোর আয়োজনে তাঁরাও কেউ কেউ রয়েছেন। মুদার বললেন, ‘‘সাধারণত মসজিদে না গেলে আমি টুপি পরি না। কিন্তু ইচ্ছে করেই টুপি পরে এখানে এসেছি। এর মধ্যে দিয়ে একটা বার্তাও দিতে চাই। কলকাতার অ-মুসলিম মহল্লায় আমাদের মতো মুসলিম নাগরিকেরা যত বেশি পাড়ার অনুষ্ঠানে জড়াব, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ যাপনের ছবিটাও সবার সামনে মেলে ধরা হবে।’’
চলচ্চিত্র পরিচালক দেবকী বসুর পুত্র, পুজোর সভাপতি দেবকুমার বসু আয়েস করে সব খাবার ভালবেসে খেলেন। প্রবীণদের অনেকের হাত থেকে কাগজের প্লেট কেড়ে নিয়ে টেবিল পরিষ্কারেও হাত লাগালেন সাহায্যকারীরা। মন্দির লাগোয়া স্কুলের খুদে পড়ুয়া,
শিক্ষিকাদের যত্ন করে খাওয়ানোর ফাঁকেই ডাক পড়ল নীচে পুজোকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে যাওয়ার। কর্মকর্তারা একমত, সম্প্রীতির এই ছবিটা বছর-বছর বহাল রাখতে হবে।
‘‘ইদানীং ধর্মে-ধর্মে বিভেদের দিকগুলি খুঁচিয়ে তুলতে চান কোনও কোনও রাজনীতিবিদ। তাই ভাব-ভালবাসার নমুনাগুলো তুলে ধরা জরুরি।’’— বলছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মইদুল ইসলাম। তবে তাঁর আফশোস, ‘‘এখনও রাজনীতিবিদদের ইফতারে যাওয়া বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সম্ভ্রমবশত কাপড়ে মাথা ঢাকা নিয়েও কেউ কেউ খামোখা বিতর্ক খুঁচিয়ে তোলেন।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy