কার্জন পার্কের ভাষা উদ্যানে আগাছায় ঢাকা পড়েছে শহিদদের স্মৃতিফলক। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
বাংলা ভাষা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। এটা বাস্তব যে, প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের একটা ভাষা রাতারাতি মরে যাবে, এটা হতে পারে না। তবে বাংলার পরিসর এবং ভাষার ভবিষ্যৎ-স্বাস্থ্যের কথা ভাবলে এ কথা মানতে বাধ্য হচ্ছি যে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোথাও বড়সড় খামতি থেকে যাচ্ছে। কোনও ভাষার স্বাস্থ্যের পক্ষে এ বড় সুখের খবর নয়।
কারণ, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েই আজ সন্তানকে মাতৃভাষা শেখানোর আগে বিদেশি ভাষা শেখাতে উঠেপড়ে লেগেছি আমরা। বাংলার বদলে তার হাতে তুলে দিচ্ছি বিদেশি ভাষার বই। এ অভ্যেস আদতে বর্তমান নাগরিক সমাজেরই অংশ। শুধু কলকাতা নয়, জেলায় জেলায় এই মানসিকতার বিস্তার ঘটেছে।
তবে এ কথাও ঠিক, যুগে যুগে ভাষা-মৃত্যুর প্রভূত উদাহরণ থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি বাংলার মুমূর্ষু অবস্থার কথা কল্পনা করে কাতর হই, তা-ও সমীচীন হবে না। কারণ, একটি ভাষায় সাহেবি বুলি ঢুকছে মানেই যে তার মৃত্যু আসন্ন— ব্যাপারটা মোটেই এত সহজ সমীকরণের নয়। তবে ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’ শুনে নাগরিক সমাজের একাংশ যে ভাবে বিরক্তি ও উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলছেন, সেটাও সেই আবেগতাড়িত। বাংলায় বসে অন্য কোনও ভাষায় ভাবের আদানপ্রদানে বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও আদতে একপ্রকার উগ্রতা। ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গেলে সেই আবেগ, উগ্রতাকে পরিহার করা বাঞ্ছনীয়।
আমাদের মাতৃভাষার ভৌগোলিক বিস্তারের দিকটা ভেবে দেখলে বলতে হয়, ভাষার এত বৈচিত্র এবং তার ব্যবহারিক বৈচিত্র মোটেই ফেলনা নয়। বরং এটাই এ ভাষার অন্যতম জোরের দিক। শুধু দুই বাংলাতেই নয়, ত্রিপুরা, অসম বা দেশের অন্যত্রও কমবেশি এই ভাষার চল রয়েছে। প্রবাসীদের হাত ধরে আজ বিদেশেও সহাবস্থান করছে বাংলা। তেমনই দেশের ইতিহাস সাক্ষী, প্রাচীন কাল থেকে বহু বিদেশি শক্তির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষায় সহজেই প্রবেশ ঘটেছে বিদেশি শব্দের। ‘বাংলিশ’ কিংবা হিন্দি মেশানো বাংলা বলার যে প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু আশ্চর্যের নয়। বরং যে কোনও চলমান ভাষার আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন কাল থেকে বাংলা ভাষায় বহু আরবি, ফারসি, চিনা শব্দের আত্তীকরণ ঘটেছে। আনারস থেকে আলপিন, চিনি থেকে চাকর— সবই কিন্তু বিদেশি শব্দ! আবার ইংরেজি অভিধানের বহু নয়া সংস্করণে বেশ কিছু ভারতীয় শব্দের অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। তাই একাধিক ভাষার মধ্যে আদানপ্রদানের এই পরিসর চলতেই থাকবে। তাতে দোষের কিছু নেই।
তার চেয়ে বরং ভাবা দরকার, আমরা বাংলা ভাষার পরিসর ক্রমশ ছোট করে আনছি কি না। এক সময়ে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন বাংলায় লেখার দাবি উঠেছিল। তা বেশি দিন ধোপে টেকেনি। গ্রামাঞ্চলে কিন্তু আজও প্রয়োজন বুঝে ডাক্তারেরা ওষুধের নামের পাশে বাকি নির্দেশ বাংলায় লিখে থাকেন। কিছু বছর আগে দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে বলেও রব উঠেছিল। কিন্তু বাংলায় ভুল বানান সমৃদ্ধ হোর্ডিং লিখে তাতে আখেরে কি কোনও লাভ আছে? তার চেয়ে বরং যত্ন নিয়ে ভাষাটা শেখায় নজর দেওয়া উচিত। যে অধ্যবসায় ও আগ্রহ নিয়ে ইংরেজি বা অন্য ভাষার চর্চা করে থাকি, সে ভাবেই না হয় আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলার অনুশীলন করাই!
আজ আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম না কি বাংলা মাধ্যম নিয়ে যে দোটানা রয়েছে, দেশের অন্যত্র এই পরিস্থিতি আরও ৩০-৪০ বছর আগেই তৈরি হয়েছিল। দেশের শিক্ষার ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার পরে উদ্বেগ ছিল, অন্য বোর্ডগুলি রাজ্যের বোর্ডের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে কি না। আর এখন সেই ছবিটা পুরো উল্টে গিয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের মোকাবিলা করতে না পেরে বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে একের পর এক বাংলা মাধ্যম স্কুল।
তাই অন্ধ ভাষাপ্রেম নয়, শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন বাংলা ভাষার সযত্ন অনুশীলন। বাংলায় বসে বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষায় কথা বলব না, বলতেও দেব না— এ হেন উগ্রতা কিন্তু ভাষা সঙ্কীর্ণতার পরিচায়ক। রবিঠাকুরের কথায় তাই বলতে হয়— ‘প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি/ সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি’।
(অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy