গায়ের রঙের আমূল পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়ে বিকোয় ফেয়ারনেস ক্রিম।
জ্ঞানগম্যি হওয়ার পর থেকেই প্রতিমা তার গায়ের রং নিয়ে কত কথাই শুনে এসেছে। ‘অন্ধকারে দাঁড়ালে দেখা যায় না’, ‘ঠিক যেন দাঁড়কাক’— গায়ে জ্বালা-ধরানো এ রকম সব মন্তব্য উড়ে আসত তার দিকে! কাটা-কাটা নাক-চোখ আর মাথায় এক ঢাল চুলের জন্য কেউ তার রূপের প্রশংসা করলেও সেই স্তুতি অনেক সময়েই ‘কালো কিন্তু সুন্দর’ বাক্যবন্ধের আড়ালেই ঢাকা পড়ে যেত। ‘কালো’ ও ‘সুন্দর’— এই শব্দ দু’টো জুড়তে কেন ‘কিন্তু’র প্রয়োজন, সেই প্রশ্ন প্রতিমার মনে ঘুরপাক খেলেও উত্তর খোঁজার বিশেষ চেষ্টা সে করেনি কখনও। তার পরে ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপনে যখন তার সম্পর্কে লেখা হল ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’, খুব একচোট হেসেছিল প্রতিমা। সে ‘উজ্জ্বল’ হল কবে, মাকে জিজ্ঞাসা করায় তিনিও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি, ‘‘মিশমিশে কালো লিখলে কি আর কেউ শখ করে তোর সঙ্গে সম্বন্ধ করতে আসবে! বিজ্ঞাপনে ওই সব লিখতে হয়।’’ বিজ্ঞাপনের ভাষা পাল্টাল না। বরং মাসকাবারির ফর্দে ফর্সা হওয়ার ক্রিমের সংখ্যা বেড়ে গেল।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশের পায়ের চাপে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর খবরে যখন সারা পৃথিবী উত্তাল, মার্কিন মুলুকেই বছর সাতেক আগে শুরু হওয়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পালে যখন নতুন হাওয়া লেগেছে, তখন প্রশ্ন ওঠে, আন্দোলন-প্রিয় বাঙালির মনে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কি আদৌ পাল্টেছে? না কি প্রতিমার মতো অসংখ্য বাঙালি মেয়ের মনে এখনও ঘুরপাক খায় ওই প্রশ্নটা— ‘কালো’ আর ‘ভাল’কে জুড়তে ‘কিন্তু’ ব্যবহার করতে হবে কেন?
‘হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড’ জানিয়েছে, তাদের ফর্সা হওয়ার ক্রিমের নাম পাল্টাচ্ছে। ‘ফেয়ার’ হটিয়ে দিয়ে কোনও ‘বর্ণ’-গন্ধহীন শব্দ রাখতে চায় ব্র্যান্ডটি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ঈপ্সিতা হালদার মনে করেন, ‘‘নাম বদলটা খুব জরুরি পদক্ষেপ। কিন্তু এটুকুই কি যথেষ্ট? স্মিতা পাটিল থেকে নন্দিতা দাস, এঁদের গায়ে আমরা সহজেই একটা ‘অন্য ধরনের সৌন্দর্যের’ তকমা এঁটে দিই। যেন কালোও সুন্দর, কিন্তু যদি তার কালো-হরিণ চোখ থাকে, তবেই।’’ তবে ফিনান্সিয়াল মার্কেটিংয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শম্পা চক্রবর্তীর মতে, এই নাম পাল্টানোর পদক্ষেপ সংস্থাটির পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সমীক্ষা বলছে, অনেকেই ‘ফর্সা’ শব্দটি দেখে ক্রিম কেনেন। ফলে এ ক্ষেত্রে এই ক্রিমের বিক্রি কমে যেতে পারে।
ফর্সা হওয়ার কিছু ক্রিম যে চামড়ার মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, তা বারবার বলেন চিকিৎসকেরা। ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজের চর্ম বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মহিমাঞ্জন সাহার কথায়, ‘‘এটা একটা সামাজিক ব্যাধি। ফর্সা হতে চেয়ে আমাদের হাসপাতালে দিনে ১৫-২০ জন কমবয়সি মেয়ে আসেন। তাঁদের বোঝাতে পারি না যে, ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়া যায় না।’’
একই সতর্কবার্তা বিসি রায় শিশু হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগীয় প্রধান নীলেন্দু শর্মার গলায়। বললেন, ‘‘পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করে এই সব সংস্থা। বড় বড় সংস্থার তৈরি পণ্যে উপাদান লেখা থাকলেও বাজারে হাজার হাজার সংস্থা ও তাদের অসংখ্য ক্রিম রয়েছে। যার উপাদান সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।’’ চিকিৎসকেরা সতর্ক করলেও উজ্জ্বল ত্বকের মোহে সেই বিপদের কথা ভুলে যান অনেকেই।
বিপণন জগতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত অমিতাভ সিনহার কথায়, ‘‘গায়ের ফর্সা রং নিয়ে এই মাতামাতি আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। এটা ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার! অনেক বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, গায়ের রং পাল্টে গেলে জীবনটাই বদলে যাবে। এই ধরনের বিজ্ঞাপনের পিছনে যে মানসিকতা রয়েছে, তারও পরিবর্তন প্রয়োজন।’’
পরিবর্তন যে প্রয়োজন, মানছেন অনেকেই। পাল্টে ফেলার পথে হেঁটেই ম্যাট্রিমনিয়াল ওয়েবসাইট ‘শাদি ডট কম’ জানিয়েছে, পাত্র-পাত্রীর গায়ের রং উল্লেখ করার যে আলাদা ‘ফিল্টার’ ছিল, তা বন্ধ করছে তারা।
‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা’র মা-বাবারা শুনছেন তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy