(বাঁ দিকে) স্বপ্নদীপ কুণ্ডু এবং রামপ্রসাদ কুণ্ডু।
ফোন ধরেই অঝোরে কান্না। গোঙাতে গোঙাতে অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন বটে। কিন্তু বলতে পারলেন না! এর পরেই প্রৌঢ়ের তীব্র আর্তনাদ— ‘‘আমার আর সহ্য করার ক্ষমতা নেই! আমার ছেলে, আমার ছেলে, আমার ছেলেকে ওরা...।’’
তত ক্ষণে গলা কাঁপতে শুরু করেছে রামপ্রসাদ কুণ্ডুর। এর পর নিজেকে কিছুটা সামলানোর চেষ্টা করে কাঁপা গলাতেই তিনি বলতে থাকেন, ‘‘আমার ছেলেকে খুব মার মেরেছে ওরা। একেবারে মেরেই ফেলল!’’ তার পর আবার কান্না। কাঁদতে কাঁদতেই রামপ্রসাদ বলেন, ‘‘সারা গায়ে কালশিটে দাগ! খুব মারধর করেছে আমার ছেলেকে ওরা।’’ অসহায় পিতার আক্ষেপ, ‘‘ছেলে বার বার বলছিল, ও ভাল নেই। আমরা কেন গিয়ে নিয়ে এলাম না ওকে? তা হলে হয়তো প্রাণটা বেঁচে যেত।’’
বুধবার গভীর রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের এ-২ ব্লকের নীচ থেকে নগ্ন ও অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া যায় বাংলা বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুকে। বৃহস্পতিবার ভোরে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বপ্নদীপের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় র্যাগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। পিতা রামপ্রসাদের অভিযোগ, ‘‘ছেলের মৃত্যুর জন্য হস্টেলের সিনিয়রেরাই দায়ী। ওরা (সিনিয়ররা) হয়তো ভেবেছে, এই ছেলে (স্বপ্নদীপ) এখান থেকে চলে গেলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। ওই জন্য ওকে মেরে ফেলল!’’
নদিয়ার বগুলা থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন স্বপ্নদীপ। রামপ্রসাদ জানান, স্বপ্নদীপের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাঁরা বুঝেছিলেন যে, ছেলে ভাল নেই হস্টেলে। শুক্রবারই হস্টেল থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার মধ্যেই এত কিছু ঘটে গিয়েছে! বাবার কথায়, ‘‘ও (স্বপ্নদীপ) একটু ভুল করেছে। আমরাও ভুল করেছি। ওর কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, ওর উপর ভীষণ অত্যাচার হচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই হস্টেলে গিয়ে ওকে নিয়ে এলে এ সব হত না। ও ভেবেছিল, শুক্রবার পর্যন্ত ক্লাস করবে। আমরা ভেবেছিলাম, শুক্রবার গিয়েই ওকে নিয়ে আসব।’’
পরিবার সূত্রে খবর, বুধবার রাত ৯টা নাগাদ মাকে ফোন করেছিলেন স্বপ্নদীপ। ফোনে বার বার তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছিলেন। শুক্রবার রামপ্রসাদ জানান, বুধবার রাতে যখন র্যাগিং চলছিল, সেই সময় তাঁরা স্বপ্নদীপের মোবাইলে ফোন করেছিলেন। কিন্তু সেই ফোন কেউ তোলেননি। বরং, ও দিক থেকে ঘুরিয়ে ফোন করা হয়েছিল। স্বপ্নদীপের বাবা বলেন, ‘‘আমাদের ফোন রিসিভ করেনি। ওদের ফোন থেকে আমাদের ফোন করেছিল। ওকে (স্বপ্নদীপকে) সিনিয়রেরা ফোনে বলতে বলছিল, ‘বল ভাল আছিস’। আর ছেলে ফোনে মা-বাবা করে আর্তনাদ করছিল। ক্রমাগত বলে যাচ্ছিল, ‘মা, আমি ভাল নেই। আমাকে নিয়ে যাও।’ ওর দাদাও ফোন ধরে কথা বলেছিল। আমার ছেলে অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। ওকে কখনও এ রকম আচরণ করতে দেখিনি।’’
তদন্তকারীরা ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলার পর জানতে পেরেছেন, বুধবার বিকেল থেকে ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ করছিলেন স্বপ্নদীপ। হস্টেলে থাকতে চাইছিলেন না তিনি। গামছা পরে বার বার শৌচাগারে যাচ্ছিলেন। তিনি ‘সমকামী’ নন বলেও অন্যদের বার বার বলছিলেন। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে প্রশ্ন ওঠে, কেনই বা তিনি বার বার সে কথা বলছিলেন! পড়ুয়াদের একাংশের বয়ান থেকে পুলিশ সূত্রের আরও দাবি, স্বপ্নদীপ যখন ঝাঁপ দেন, সেই সময় কাশ্মীরি এক পড়ুয়া তাঁকে আটকাতে যান। কিন্তু ঘামে ভিজে থাকায় হাত পিছলে যায়। ওই পড়ুয়া-সহ কয়েক জন আবাসিকের বয়ান নথিবদ্ধ করা হয়েছে বলে খবর পুলিশ সূত্রে। রামপ্রসাদের অভিযোগ, র্যাগিংয়ের সময় তাঁর ছেলেকে কিছু খাওয়ানো হয়ে থাকতে পারে। স্বপ্নদীপের মাথায় রড দিয়ে মারা হয়ে থাকতে পারে বলেও দাবি বাবার। তাঁর কথায়, ‘‘ওকে তো উলঙ্গ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। প্রচুর টর্চার (অত্যাচার) করেছে। খুব মারধর করেছে। মাথায় ফ্র্যাকচার ছিল। হয়তো মাথায় রড দিয়ে মেরেছে।’’
রামপ্রসাদ জানান, তাঁ ছেলের দেহের দ্বিতীয় বার ময়নাতদন্তের জন্যেও তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। পুলিশকে অনুরোধও করেছিলেন এ বিষয়ে। তিনি বলেন, ‘‘ওর সারা গায়ে দাগ ছিল। আমরা পুলিশকে বললাম, ময়নাতদন্তে যা পাওয়া গিয়েছে, তাতে কি কাজ হবে? না কি আবার ময়নাতদন্ত হওয়া দরকার? পুলিশ বলল, যা পাওয়া গিয়েছে তাতেই হবে।’’ রামপ্রসাদ জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। ওঁকে জানিয়েছি, আমার ছেলে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনার ছেলেকে তো ফিরিয়ে দিতে পারব না। তবে দোষীরা যাতে শাস্তি পায়, সেই ব্যবস্থা করব।’’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy