ভোগান্তির রাজপথ ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
পূর্বাভাস ছিল দু’রকম ভোগান্তির। এক, বিজেপি ও তৃণমূলের মিছিলের জেরে যানজট ও রাস্তা অবরুদ্ধ হওয়া। দুই, নিম্নচাপ বাংলাদেশের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার ফলে গুমোট গরমের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু দিনের ব্যস্ত সময়ে মেট্রোও যে টানা দু’ঘণ্টা বিকল হয়ে পড়বে, তা জানা ছিল না কারও। ফলে এক দিকে, অস্বস্তিকর আবহাওয়া, অন্য দিকে কলকাতার বুক চিরে দু’টি রাজনৈতিক দলের মিছিল আর তার উপর মেট্রো বিভ্রাটের ত্র্যহস্পর্শে সোমবার মহানগরের রাজপথে বেরোনো মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠল।
শুধু রাস্তায় বাসে-ট্রামে-গাড়িতে নয়, পাতালেও মেট্রোযাত্রীদের কার্যত নাভিশ্বাস উঠে ওঠে। ১০টা ৫৫ মিনিটে কবি সুভাষ থেকে ছেড়ে যে মেট্রোটি দমদম যাচ্ছিল, ময়দান থেকে পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে ঢোকার ১০০ মিটার আগে সেটি আচমকা থেমে যায়। ঘড়িতে তখন ১১টা ২০। চালক এগোতে না পেরে পিছনে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ট্রেনটি নড়াতে পারেননি। পরে মেট্রো সূত্রে জানা গিয়েছে, তৃতীয় লাইন থেকে বিদ্যুৎ ওই রেকেই পৌঁছচ্ছিল না।
আষাঢ়ের প্যাচপেচে গরমে মেট্রোর ভিতরে তখন কাহিল দশা। অনেকটা বহুতল বাড়িতে লিফ্টে ওঠা-নামার সময়ে মাঝপথে লোডশেডিং-এ আটকে যাওয়ার মতো। এক যাত্রীর কথায়, “ভাগ্যিস ওই রেকটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত না ছিল না। বাতানুকূল রেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে একটুও হাওয়া চলাচল করত না। দমবন্ধ হয়ে বোধহয় মারাই পড়তাম।”
দুর্ভোগ অবশ্য কম কিছু হয়নি। কারণ, ব্যস্ত সময়ে প্রতিটি কামরাই ছিল ভিড়ে ঠাসা। কুলকুল করে ঘামছিলেন প্রায় সকলেই। সঙ্গে প্রায় দমবন্ধকর অবস্থা। কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা দেওয়া মানুষ তো বটেই, ট্রেনে ছিল স্কুলের কচিকাঁচারা, এবং কয়েক জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও অশক্ত মানুষও। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় শিশু ও বয়স্কদের। দেড় ঘণ্টা ঠায় আটকে থেকে যাত্রীরা তখন ভাবছেন, আদৌ বন্দি দশা থেকে মুক্তি মিলবে কি না।
যানজটে থমকে গিয়েছে অ্যাম্বুল্যান্সও। সোমবার, শহরে। ছবি: সুমন বল্লভ
শেষমেশ যাত্রীরা মুক্ত হলেন ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে তাঁদের অবস্থা সঙ্গীন। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে মেট্রো পরিষেবাও। প্রায় দু’ঘণ্টা কবি সুভাষ থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার এবং সেন্ট্রাল থেকে নোয়াপাড়া পর্যন্ত চলছিল মেট্রো রেল। কিন্তু টালিগঞ্জ থেকে সেন্ট্রাল অংশে বেলা ১১টার পর থেকে ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ ছিল পরিষেবা।
ধর্মতলা যেতে শ্যামবাজার থেকে মেট্রোয় উঠেছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী অরুণ ভট্টাচার্য। বিভ্রাটের জেরে সেন্ট্রালে নামতে বাধ্য হন তিনি। অরুণবাবুর কথায়, “এই নাকি কলকাতার লাইফলাইন! এই অবস্থা নিয়ে আবার অন্য রুটে মেট্রো চালু হবে!” দমদম থেকে মেট্রোয় ওঠা সরকারি কর্মচারী রাজু দাস বলেন, “ভাড়া বাড়ার পর থেকে মেট্রোর রেক যেন বেশি করে খারাপ হচ্ছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে এই নাটক লেগেই আছে।”
মেট্রো স্টেশনগুলির বাইরে তখন থিকথিকে ভিড়। যার জন্য কোথাও যানবাহনের গতি অতি মন্থর হয়েছে, কোথাও হয়েছে যানজট। সড়কপথে মেট্রোর রুট বরাবর যে সব বাস-মিনিবাস-অটো যায়, তার একটিতেও তিলধারণের জায়গা নেই। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের কাছে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে বেলা পৌনে একটার সময়েও বাসের ফুটবোর্ডে ঝুলছিলেন গলদঘর্ম যাত্রীরা।
তার উপরে এ দিন সকাল থেকেই আকাশ ছিল ঘোলাটে। হাওয়া ছিল না বললেই চলে। আবহাওয়া দফতর জানায়, এ দিন অস্বস্তিসূচক ছিল ৬৫ ডিগ্রি। হাওয়া অফিস আগামী কয়েক দিনে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাসও দিতে পারেনি।
এই অবস্থায় দিনেদুপুরে একটু স্বস্তিতে গন্তব্যে যেতে একটি ফাঁকা ট্যাক্সি পেলেই ঘিরে ধরছেন জনা পনেরো মানুষ। অন্যদের গুঁতো মেরে সরিয়ে যিনি আগে ট্যাক্সির দরজা খুলতে পেরেছেন, তিনিই ভাগ্যবান। রাসবিহারী থেকে পার্ক স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত মিটারে ৯০ টাকা ভাড়া হয়েছে দেখে আরোহী ১০০ টাকার নোট দিয়ে ১০ টাকা ফেরত চাইলে চালক বলেছেন, “আজ এই টাকাটাও ফেরত দিতে হবে?”
কোথাও কোথাও আবার অতিরিক্ত পঞ্চাশ, একশো টাকা পর্যন্ত দাবি করেছেন ট্যাক্সিচালকেরা। সুযোগ বুঝে দ্বিগুণ ভাড়া হাঁকতে শুরু করে কিছু রুটের অটো-ও। ছ’টাকার ভাড়া হয়ে যায় বারো টাকা।
মেট্রো পরিষেবা ঠিক হওয়ার পরেও অবস্থা শুধরোয়নি। কারণ, পাতালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের পূর্ব দিক জুড়ে শুরু হয় বিজেপি-র মিছিল। রাজ্যে শাসকদলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিজেপি-র এই মিছিল কলেজ স্কোয়ার থেকে কলুটোলা স্ট্রিট ধরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছয়। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের এক দিক বন্ধ থাকায় শুরু হয় তীব্র যানজট। আবার রেলে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে এর আধ ঘণ্টা পরে দুপুর আড়াইটে নাগাদ তৃণমূলের মিছিল সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড ধরে চৌরঙ্গি হয়ে মেয়ো রোডে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে পৌঁছয় সওয়া তিনটে নাগাদ। ফলে, প্রায় আধ ঘণ্টা এস এন ব্যানার্জি রোড বন্ধ থাকে। পৌনে তিনটে থেকে সওয়া তিনটে পর্যন্ত বন্ধ থাকে চৌরঙ্গির দক্ষিণমুখী যানচলাচলের প্রান্ত।
শাসক দলের মিছিল পার্ক স্ট্রিট-চৌরঙ্গির মোড় থেকে মেয়ো রোডে ঢুকলে রাস্তার দু’দিকই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মিনিট পনেরো যানশাসন বলে আর কিছু থাকেনি। এস এন ব্যানার্জি রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, চৌরঙ্গি ছাড়াও নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট ও লেনিন সরণির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাও তীব্র যানজটে থমকায়। ধমর্তলা চত্বরে এ দিন তৃণমূল ও বিজেপি-র সমাবেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির নদিয়া শাখার জমায়েতও ছিল। বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে চারটে পর্যন্ত ওই তল্লাটে ছিল কয়েক হাজার মানুষের ভিড়। ফলে মেট্রো-দুর্ভোগ ও রাজপথে যানজট পেরিয়ে মানুষ যখন কলকাতার কেন্দ্রে, ধর্মতলার অফিসপাড়ায় পৌঁছলেন, তখন তাঁদের নতুন যন্ত্রণার শুরু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy