সাদামাঠা পোস্টারে ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই একফোঁটা। কম্পিউটারে ছাপা বড় বড় হরফে কথাগুলোও ভণিতাহীন, সোজাসাপ্টা। ‘কাপল ফ্রেন্ডলি’! উপরে অতিথিশালা (গেস্ট হাউস) শব্দটি। নীচে তিন ঘণ্টায় ৪৯৯ টাকা দক্ষিণাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একেবারে নীচে চোখে পড়ার মতো হরফে একটি মোবাইল নম্বরও মজুত। কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের দেওয়ালে ভিতরে বাইরে এ হেন যুগলবান্ধব বিজ্ঞাপনটি দেখে অনেকেই থমকে তাকাচ্ছেন। চিরকালীন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে কারও কারও ধাক্কা লাগছে। আবার ভিড়াক্রান্ত মহানগরে দুষ্প্রাপ্য নিভৃতির এমন সুলভ তিন ঘণ্টাকালীন দর নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা।
একটু নিভৃতির খোঁজে হন্যে যুগলদের একদা এ শহরের সাবেক তেলচিটে পর্দার কাঠের কেবিন ভারী পছন্দ ছিল। পূর্ণেন্দু পত্রীর বিখ্যাত ‘কথোপকথন’-এ শুভঙ্কর নন্দিনীকে ডাকেন, ‘আসবে কি সেই রেস্টুরেন্টে সিতাংশু যার মালিক / রুপোলি ধান খুঁটবে বলে ছটফটাচ্ছে শালিক’! নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমনের গানেও ছিটেফোঁটা গোপনীয়তার মালিকানাহীন যুগলদের যন্ত্রণা বার বার মূর্ত। ‘ময়দানে যেই মেটাবে ঠোঁটের জ্বালা, বাগড়া দেবেই বেরসিক ফেরিওয়ালা’, এমন অভিজ্ঞতা নানা যুগে এ শহরের নানা প্রজন্মের যুগলদের খুব অচেনা নয়। তবু ঘণ্টা মেপে প্রেমের সময়ের এমন অসঙ্কোচ বিজ্ঞাপন এ যুগেও খানিক চোখে লাগছে।
আবার কেউ বলছেন, অ্যাপ মারফত ঘর ভাড়ার যুগে ঘণ্টা কয়েকের এই বন্দোবস্ত নতুন কী! ঘণ্টা পিছু ঘর ভাড়ার নানা আস্তানা শহরে অনেক কালই গেড়ে বসেছে। জনমানসে তার সঙ্গে জড়িয়ে খানিক নিষিদ্ধ হাতছানিও। ভারতের বিভিন্ন শহরে এই ধরনের ঠেকে গিয়ে যুগলেরা পুলিশের হাতে হেনস্থা হচ্ছেন বা সিসি ক্যামেরার ফাঁদে বিপন্ন হচ্ছেন, এমন আখ্যান নানা একেলে সিনেমা, ওয়েব সিরিজেও বিস্তর দেখা গিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনটির সূত্রে যোগাযোগ করে জানা গেল, অতিথিশালাটি ইএম বাইপাস লাগোয়া এলাকায়। তাঁদের বক্তব্য, প্রাপ্তবয়স্ক দু’জন পরিচয়পত্র দেখিয়ে কিছু ক্ষণ সময় কাটানো বেআইনি নয়। যুগলদের পুলিশি জুলুমে অভয় দিতেই বিজ্ঞাপনী বার্তা। ঘণ্টা দুয়েক আগে ফোন করলেও ঘরের বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সল্টলেক এলাকাতেও এমন কিছু ঘণ্টার আস্তানা যুগলদের মধ্যে জনপ্রিয়। তবু প্রকাশ্যে ঘোষণা করে এমন 'ব্যবস্থা' খুব চেনা নয়। প্রবীণ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছেন, “মানুষের চরিত্রের নানা দিক থাকে। তাকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন ব্যবসা চলছে, এ তো স্পষ্ট।”
এমনিতে ছোট, বড় শহরের রেলস্টেশন, বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় কয়েক ঘণ্টার ঘর ভাড়ার রীতি নানা কেজো প্রয়োজনেই দীর্ঘ দিন চলছে। বেসরকারি হাসপাতাল লাগোয়া কয়েকটি পাড়ায় রোগী বা তাঁর পরিজনের জন্য কয়েক ঘণ্টার আস্তানা ভাড়া দেওয়ার কথা শোনা যায়। আবার কেউ বলছেন, দুপুরের নির্জন মেট্রো স্টেশনে যুগলদের ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তের ছবি যেখানে আজও নেটমাধ্যমে ঝড় তোলে, তাতেও প্রেমিক-প্রেমিকাদের আড়াল খোঁজার তাগিদ তৈরি হয়।
‘অ্যাসোসিয়েশন অব টুরিজম সার্ভিস প্রোভাইডার অব বেঙ্গল’-এর সেক্রেটারি তথা শহরের হোটেল ব্যবসায়ী সমর ঘোষের কিন্তু মত, ‘‘এটা স্বাস্থ্যকর নয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিয়মের অপব্যবহার করছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের বৈধ গেস্ট হাউস চালানোর লাইসেন্সও থাকছে না। পুলিশ এবং পুরসভার এটা দেখা উচিত।’’ শহরে অন্য ব্যবসার মোড়কে যৌন কারবার চালানোর অভিযোগও অবশ্য বহুচর্চিত। যুগলদের সাহচর্যের নামে গোলমেলে কাউকে প্রশ্রয় দেওয়ার আশঙ্কাও অনেকের কাছে অমূলক নয়। শহরের মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, “কোনও গেস্ট হাউসের আড়ালে অনৈতিক কাজ চললে এবং বিষয়টি পুরসভার নজরে এলে আমরা পুলিশে অভিযোগ করি। এ ক্ষেত্রে আপাতত কিছু করার নেই।” লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘হোটেলের ব্যবসার আড়ালে অন্য কিছু চললে মাঝেমধ্যেই অভিযান চালানো হয়। হোটেল বা গেস্ট হাউসের মালিকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা
নেওয়া হয়।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)