উত্তপ্ত আরজি কর হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
দেশের শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ইলেক্ট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকও নির্দেশিকা জারি করে সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলিকে আর জি কর-কাণ্ডে নির্যাতিতার নাম ও ছবি মোছার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও নিহত তরুণীর নাম ও ছবি-সহ বহু ভিডিয়ো এখনও ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। জনপরিসরে বহুল চর্চিত এই ধরনের বিষয় নিয়ে ‘কনটেন্ট’ তৈরি করার হিড়িকে কেন সামান্য দায়িত্ববোধও দেখা যাচ্ছে না নেট-দুনিয়ায়? এই প্রশ্ন তুলছেন মনোবিদেরাও।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরেই আলোড়ন পড়ে যায় রাজ্য তথা দেশ জুড়ে। সমাজমাধ্যমের ডাকেই একত্রিত হয়ে রাতের পথে প্রতিবাদে নামেন অগণিত মহিলা। সমাজমাধ্যমের সুবাদে যেমন প্রতিবাদে এক হতে পেরেছিলেন রাজ্যের শহর-গ্রামের মহিলারা, তেমনই সমাজমাধ্যমেই ঘটনার নানা রকম বিবরণ, নেপথ্যকাহিনী ইত্যাদি নিয়েও অজস্র ভিডিয়ো তৈরি হতে থাকে। সমাজমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেকে যেমন প্রতিবাদ নথিভুক্ত করতে বা নিজের অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার জন্য ভিডিয়ো তৈরি করেন, তেমনই অনেকে আবার চর্চায় থাকা বিষয়ে ‘কনটেন্ট’ তৈরি করে ‘ভিউ’ বা ‘লাইক’ পেতেও নানা রকম ভিডিয়ো তৈরি করতে থাকেন। কারণ, দর্শক বাড়লে সেই ভিডিয়ো থেকে বিজ্ঞাপনও আসে। অভিযোগ, এমন বহু ভিডিয়োতেই নির্যাতিতার নাম, ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, যা আইনবিরুদ্ধ।
মনোবিদ ও মনোরোগের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এমন অনেক ভিডিয়ো দেখা গিয়েছে বা এখনও দেখা যাচ্ছে, যা দেখলে বোঝাই যাবে, নিছক জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্যই তা করা হয়েছে। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় জানালেন, তিনি ইউটিউবে থাকা এমন একটি ভিডিয়োর কথা জেনেছিলেন, যেখানে নিহত চিকিৎসকের আত্মাকে প্ল্যানচেটে ডাকা হচ্ছে। এ ছাড়া, আরও অজস্র রিল, ভিডিয়ো দেখা গিয়েছে ইউটিউব বা সমাজমাধ্যমের অন্য নানা ক্ষেত্রে। তাঁর মতে, কেবল সচেতনতার প্রচারে এই প্রবণতা বন্ধ হবে না। রিমা বলেন, ‘‘যাঁরা এ সব করছেন, তাঁদের বুঝতে হবে, তাঁদের এই কাজ বিচার আনার ক্ষেত্রে কোনও কাজে লাগবে না। বরং তাঁরা আইন ভাঙছেন। আইনি পথে ব্যবস্থা হলেই হয়তো এমন প্রবণতা বন্ধ হতে পারে।’’
ঘটনার দিন ‘ঠিক’ কী ঘটেছিল, এমন শিরোনামে বহু ভিডিয়ো আপলোড করা হয়েছে নানা ভাষায়। সেগুলি লক্ষ লক্ষ দর্শক দেখেওছেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উপল চক্রবর্তী মনে করেন, সার্বিক ভাবে নেট-দুনিয়ায় হালে থ্রিলার বা রহস্যের চাহিদার যে বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে, এমন নানা ভিডিয়ো করার ক্ষেত্রে সেই চাহিদাও কাজ করে থাকতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘হালে ওয়েব সিরিজ়, সিনেমা-সহ জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে রহস্য-রোমাঞ্চ যে ভাবে উত্তেজক মনোরঞ্জনের খাদ্য হয়ে উঠেছে, সেই প্রবণতাই এর পিছনে কাজ করতে পারে। কারণ, যাঁরা এই ধরনের ভিডিয়ো বানাচ্ছেন, তাঁরা জানেন, এগুলো দেখার জন্য প্রচুর দর্শকও রয়েছেন।’’
সুপ্রিম কোর্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট নির্দেশের পরেও কেন এমন একাধিক ভিডিয়ো থেকে যাচ্ছে? ইউটিউব কর্তৃপক্ষের তরফে ইমেলে দাবি করা হয়, বিশ্ব জুড়েই সরকার বা আইনি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশের ভিত্তিতে ইউটিউব থেকে কোনও ভিডিয়ো সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের স্পষ্ট নীতি রয়েছে। ইউটিউবের বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের নির্দেশ পেলেই যে কনটেন্টের সম্বন্ধে তা বলা হচ্ছে, সেটি বিধি লঙ্ঘন করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি ও সরকারের নির্দেশ মতো সেটি মুছে ফেলা হয়।’’ তবে, বাস্তব যে অন্য রকম, তা সমাজমাধ্যম ঘাঁটলেই চোখে পড়ছে।
আবার, সমাজমাধ্যমের এই বিরাট পরিসরে কী কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে, তার সম্পূর্ণ নজরদারি করা যে কঠিন, তা-ও মানছেন বিশেষজ্ঞেরা। এ ক্ষেত্রে নেট-জনতার সচেতনতা ও দায়িত্ববোধও গুরুত্বপূর্ণ বলে মত তাঁদের। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুকন্যা সর্বাধিকারীর মতে, ‘‘সমাজমাধ্যমের যুগে এখন যে কোনও বিষয়েই ছবি, ভিডিয়োর আধিক্য অত্যন্ত বেশি। তাই এমন ঘটনা যখন ঘটে, তখন দায়িত্বশীল ও চিন্তাশীল থেকে, রুচিবোধ বজায় রেখে কোনও বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো প্রয়োজন। খুব সরব না হয়ে নীরব, পরিশীলিত প্রতিবাদও শক্তিশালী হতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy