সাবধানী: শালওয়ালাদের ডেরায়। সোমবার, মধ্য কলকাতায়। নিজস্ব চিত্র
বাবার বাংলা বুলিতে এখনও মিশে ভূস্বর্গের গন্ধ। কিছু দিন আগেও তাঁর মুখে কাশ্মীরি টানে ‘হাবডা সটেশন’ শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ত মেয়েরা। সেই প্রবীণ একদম থম মেরে গিয়েছেন।
তিন দশক আগে শ্রীনগর থেকে এসে থিতু কলকাতা অন্তঃপ্রাণ পরিবারের মেয়ের স্বরেও আতঙ্কের ছোঁয়াচ— ‘‘কলকাতাকে এক ফোঁটা অবিশ্বাস করার কথা ভাবতেও পারি না। কিন্তু এখন ক’টা দিন একটু সামলে থাকতে হচ্ছে! প্লিজ় আমরা ক’জন ভাইবোন, কোথায় বাড়ি, এত খুঁটিনাটি লেখার দরকার নেই।’’
গোটা দেশ যে পথেই হাঁটুক, কলকাতার ভালবাসার মনটায় কখনও চিড় ধরবে না, এই বিশ্বাস এখনও সবুজ উপত্যকার অনেক ঘরেই। তবু পুলওয়ামা-কাণ্ডের টাটকা অভিঘাতে এই শহরেও চাপা আতঙ্কের গুমোট। কিছু উটকো হুমকির জেরে তপসিয়ায় কাশ্মীরি ডাক্তারবাবুর ঘরে পুলিশ পাহারা বসেছে। বেহালায় ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ঝগড়ায় কাশ্মীরি শালওয়ালাদের ডেরায় কারা চোখ রাঙিয়েছে। নানা খবর হাওয়ায় ভাসছে! তালতলার এক তস্য গলির কাশ্মীরি-কোঠির দোতলায় বাডগাম জেলার মুসু গ্রামের শালওয়ালারা সব শুনে মিটিমিটি হাসছিলেন! কিছু পরিচিতের সূত্র ধরে আগত সাংবাদিকের পরিচয়পত্র এক বার দেখতে চাইলেন। তার পরে মেঝেয় পাতা তোষকে বসিয়ে গুলাম নবি বললেন, ‘‘যদি কিছু হয়েও থাকে, শুধু সেটাই সত্যি নয়! কয়েক জন খারাপ ব্যবহার করতে পারেন! কিন্তু ওই কাশ্মীরি ভাইদের পাশেও তো লোকাল লোকই ছিল!’’
গুলাম, নুর মহম্মদ, আব্দুল কাইয়ুমদের বাংলায় ‘র’টা বাঙালিদের থেকে খানিক আলাদা। স্কুলকে ‘সকুল’, স্টেশনকে ‘সটেশন’ আর হিন্দির ‘নেহি’কে ‘মাত’ বলার অভ্যাস! তা বাদ দিলে গড়গড়িয়েই বাংলা বলেন তিন দশক ধরে বছরের অর্ধেকটা কলকাতাবাসী এই শাল বিক্রেতারা। কাইয়ুম বললেন, ‘‘শুনুন দাদা, শ্রীনগর নয়, কলকাতায় রয়েছি শুনলেই বেশি শান্তি পান মা।’’
আরও পড়ুন: পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার চার দিন পরে হত জইশের শীর্ষ নেতা কামরান
এ বাড়ির শালওয়ালাদের যাতায়াত প্রধানত বেলেঘাটা, কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান, সল্টলেকে। সাইকেল-বাহনে তরতরিয়ে খালধারের রাস্তা ধরে টালাপার্ক, বিটি রোডেও কয়েক বাড়ি যাওয়া হয়। সোমবার দুপুরে সেই টো টো কোম্পানির ঝক্কি ছিল না। শীতশেষে শাল, কার্পেট, সালওয়ার সুট, জ্যাকেট, স্কার্ফ, স্টোলের পসরা প্রায় সবই খতম। শুধু কিছু বকেয়া পাওনা নিতে হবে। মার্চের মাঝামাঝি অবধি তাই শালওয়ালারা বেশির ভাগই কলকাতায় থাকবেন। তালতলা-রিপন স্ট্রিটের পাঁচমিশেলি মহল্লায় অনেকেরই ডেরা।
শ্রীনগর বিমানবন্দরের খুব কাছে গুলমার্গের রাস্তায় বাডগামের এই কাশ্মীরিদের গাঁয়ে মেয়ে-বৌরা সালওয়ার সুট, কর্পেটের গায়ে নকশা ফুটিয়ে তোলেন। ওঁরা বলছিলেন, ভূস্বর্গের ওই তল্লাটে কিন্তু খুনোখুনি, হিংসা— কিচ্ছু নেই। তবে চাকরিরও অভাব! তাই কলকাতায় ভরসা। পসরাসুদ্ধ বাঙালি অন্দরমহলে অবারিত দ্বার এই কাশ্মীরিদের ভাত, ডাল, আলুভাতে, মাছের ঝোল, রসগোল্লার স্বাদ পুরো মুখস্থ।
এমনই এক কাশ্মীরি শাল বিক্রেতার কন্যা অধুনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে পরিচিত তরুণী কিন্তু এই গোলমেলে সময়ে কাগজে নামটা চেপে যেতেই অনুরোধ করলেন। তাঁর বছর চারেক বয়সে ১৯৮৯ থেকে কলকাতায় আছেন। কিছু পারিবারিক দুর্যোগের জেরে মেয়েটির বাবা শ্রীনগর ছেড়ে কলকাতাকেই সবথেকে শান্তির জায়গা বলে বেছে নেন। বছরে এক বার শুধু শ্রীনগরে গিয়ে শাল বা তামার সামগ্রী নিয়ে আসতেন তিনি। সেই কাশ্মীরি বাবার মেয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশ্মীরি সংবাদমাধ্যমে সুফিবাদের প্রভাব নিয়ে এমফিল করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘‘সুফিবাদের খোলা মনের আধ্যাত্মিকতা কাশ্মীরিয়তের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গোঁড়া মৌলবাদের সঙ্গে লড়াইও কাশ্মীরিদের জীবনের অঙ্গ।’’
বিশ বা একুশ শতকের বহু রাজনৈতিক দুর্যোগে অনেক দূরের বিপন্নদের খোলা মনে আশ্রয় দেওয়াটাও কলকাতার পরম্পরা বলে বিশ্বাস করেন কাশ্মীরি তরুণী। বাঙালি বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে থাকার কথা কল্পনাও করেন না। চোরা আশঙ্কায় শুধু কিছু দিন নিজের শহরে সাবধানে থাকার কথা ভাবছেন তিনিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy