স্বপ্নদীপ কুন্ডু। —ফাইল চিত্র।
‘আ মার্ডার বাই ব্রিলিয়ান্ট ব্রেনস’। সেরা মস্তিষ্কদের ঘটানো একটি খুন।
এই লেখাটা লেখার সময়ে আমার দু’রকম অনুভূতি একসঙ্গে হচ্ছে। দুঃখে-কষ্টে চোখে জল আসছে। আবার ক্রোধে, ক্ষোভে, অসহায়তায় শরীর যেন রি-রি করছে। স্বপ্নদীপের মৃত্যুতে শুধুমাত্র ওর মা-বাবা কিংবা আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনেরাই কাঁদছেন না। সারা বাংলাও কাঁদছে।
কারণ, স্বপ্নদীপের মৃত্যু শুধু একটি তরতাজা, গ্রাম থেকে আসা, ভাল ছেলের মৃত্যু নয়। সাধারণ, গড়পড়তা, নিম্নবিত্ত বাঙালির স্বপ্নেরও মৃত্যু। চার দিকে অনেক আলোচনা। আমি নিজেও এ বিষয়ে এবিপি আনন্দে আলোচনায় অংশ নিয়েছি। কেউ বলছেন হত্যা, কেউ বলছেন অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো মৃত্যু, কেউ বা বলছেন আত্মহত্যা। আমিও ভাবছি, এই মৃত্যুকে কোন নামে অভিহিত করব।
আত্মহত্যা নয়। কারণ, মাত্র তিন দিন হস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতার জেরে কেউ আত্মঘাতী হবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। রাতে তাকে যতই কদর্য অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে সে খুবই খুশি ছিল। দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর আগে মাকে ফোনে স্বপ্নদীপ জানিয়েছিল যে, সে কিছু একটা নিয়ে খুব ভয়ে আছে। তৃতীয়ত, গামছা পরে বা বিবস্ত্র অবস্থায় কেউ আত্মহত্যা করতে যায় না। অর্থাৎ, আত্মহত্যার যে স্বাভাবিক লক্ষণগুলি আমরা দেখে থাকি, তা এ ক্ষেত্রে ছিল না।
এটি খুনই হোক বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো মৃত্যু, স্বপ্নদীপের সঙ্গে নিশ্চয়ই কেউ কেউ এমন আচরণ করেছিল, যাতে তার মৃত্যু হয়। শুধুমাত্র র্যাগিং বলে এই ঘটনাকে লঘু করা যাবে না। ঘটনা যা-ই ঘটে থাক, আদালত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতেই পারে। ফাঁসি না হোক, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তো বটেই।
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে, হস্টেলের কর্তারা কী করছিলেন? ডিন অব স্টুডেন্টস? সুপার?
তাঁরাও এই হত্যাকাণ্ডে প্রকারান্তরে সাহায্য করেছেন। যখন কোনও ছাত্র তাদের ফোন করেছিল, তাঁরা দৌড়ে ঘটনাস্থলে যাননি কেন? তাঁরা কি জানতেন না যে, ওই হস্টেলে র্যাগিং হয়? যুগ যুগ ধরে যা চলছে। র্যাগিং থামাতে তাঁরা কী করেছেন? এই হত্যার দায় তাঁদেরও। অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটিই বা কোথায়? দায় তো তাদেরও।
যাঁরা বলছেন, র্যাগিং বহু যুগ ধরে চলছে, তাঁদের বলব, যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার মানসিকতা রয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে সেই ভাল ভাল ছেলেমেয়েদের অনেকেই নাকি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দেন বা চাকরি নিয়ে অন্য দেশে যান। তাঁদের বলব, তাঁরাও নীচ, পিশাচ, সমাজের বোঝা। হয়তো তাঁরা আরও বেশি অপরাধ করেছেন। তাঁদের খোলা ছেড়ে রাখাটা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক।
জেনে রাখুন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা তার সঙ্গে যুক্ত হস্টেল, মেসের মতো যে কোনও জায়গায় শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন তো বটেই, সেই সঙ্গে ‘টিজ়’ করা, ‘অ্যাবিউজ়’ করা, ‘প্র্যাক্টিক্যাল জোক’ করা অথবা কাউকে এমন কিছু করতে বাধ্য করা, যা তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় করতেন না, সবই কিন্তু র্যাগিংয়ের মধ্যে পড়ে। র্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দু’বছর পর্যন্ত কারাবাস বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অথবা দুটোই হতে পারে। র্যাগিংয়ে সাজাপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের র্যাগিং-বিরোধী আইনে বলা আছে, র্যাগিংয়ের অভিযোগ পাওয়া মাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী বা ম্যানেজমেন্ট বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে ওই পড়ুয়াকে বহিষ্কার করতে হবে। এ ছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং-বিরোধী কমিটি গড়তে হবে। জানি না, এ রাজ্যের ক’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কমিটি আছে এবং নিয়মিত কাজ করছে।
শুনলাম, যাদবপুরে নাকি সিসি ক্যামেরা লাগানো নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কারা ঢুকছে-বেরোচ্ছে, তা নজরে রাখতে আই-কার্ড চালু করা নিয়েও নাকি আপত্তি জানান ছাত্রছাত্রীদের অনেকে। আমার ব্যক্তিগত মত, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসি ক্যামেরা লাগানো এবং আই-কার্ড চালু করার সময় এসেছে।
অনেকে বলছেন, দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রথম বর্ষের ছাত্রেরা নাকি ভয়েই সাক্ষ্য দিতে আসবেন না। স্বপ্নদীপের মৃত্যুর জন্য দায়ী অপরাধীরা নাকি সহজেই ছাড়া পেয়ে যাবে। আমি বলি, এই ঘটনায় পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণাদি (সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স) যথেষ্ট শক্তিশালী। যদি প্রমাণিত হয়, ঘটনার পরপরই হস্টেলের ঘরে ‘জেনারেল বডি’র মিটিং হয়েছিল, তা অপরাধীদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টার তত্ত্বকে জোরদার করবে।
শেষে বলব, কী ঘটেছে, তাতে কে বা কারা দোষী, তা বার করার দায়িত্ব তদন্তকারী দলের। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতির মতো বিষয় তো ছিলই, এ বার যদি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, তা হলে তো তাঁরা কোথাও পড়তে যেতে বা হস্টেলে থাকতেই ভয় পাবেন।
আসলে এই অপরাধীরা হয়তো আগেও এই ধরনের অপরাধ করেছে। কিন্তু ধরা পড়েনি। এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের শারীরিক ভাবে খুন করা না হলেও স্বপ্নকে খুন করা হয়েছে। তাঁরা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। আমাদের এখন করণীয় হল, সাধারণ মানুষ হিসাবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy