মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ায় বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে তিন জনের মৃত্যুর পরে সামনে আসছে বাজি তল্লাটের রোগে ভোগার বিভিন্ন দৃশ্য। ফাইল ছবি।
এলাকায় অনেকে তাঁর নাম দিয়েছিলেন সাবুর পাঁপড়। এর কারণ, তাঁর শরীরের নানা জায়গা নাকি পাঁপড়ের মতো ফুলে উঠেছিল। কেউ আবার তাঁকে খেপাতেন সাপবাজি বলে। বাজির কারখানায় বছরের পর বছর কাজ করার জেরে তাঁর চেহারা নাকি হয়েছিল এমনই। প্রতিবেশীদের দাবি, রাস্তা বা বাড়ির উঠোনে সাপবাজি পোড়ালে যেমন কিছু দিন পরেও সেই জায়গাটিতে ফোস্কা পড়ার মতো দাগ লেগে থাকে, তাঁর শরীর জুড়েও ছিল তেমনই দাগ! বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে শেষমেশ মারা গিয়েছিলেন পরিবারহীন সেই প্রৌঢ়। শেষ দিকে আর জোরে হাঁটতে পারতেন না। কাশি লেগে থাকত। কয়েক পা হাঁটার পরেই শুরু হত হাঁপানি।
শুধু ওই প্রৌঢ়ই নন। চম্পাহাটির বেগমপুর, হারাল, সোলগলিয়া বা মহেশতলার নুঙ্গি, পুটখালি, বলরামপুরের বাজি মহল্লা জুড়ে এমন নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে অনেকের শরীরেই। সবচেয়ে বেশি চর্মরোগ। গভীর ঘা হওয়া বা ফোস্কা পড়া 'জলভাত'। কাজ সেরে ওঠা শ্রমিকদের স্নানের ব্যবস্থা করা আর মালিকপক্ষের তরফে দিনের শেষে দৈনিক মজুরির সঙ্গে সাধারণ মানের কিছু ওষুধ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করা হয় না বলে অভিযোগ। প্রায় প্রতি ঘরে শ্বাসনালি, ফুসফুসের সমস্যা। চোখের প্রদাহ নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের খুব কম বয়সে চোখে ছানি পড়ে গিয়েছে। গত সোমবার মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ায় বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে তিন জনের মৃত্যুর পরে সামনে আসছে বাজি তল্লাটের রোগে ভোগার এমন বিভিন্ন দৃশ্য।
মণ্ডলপাড়ার গ্রামের এক চিকিৎসক বলছিলেন, ‘‘এক সময়ে বাজি ব্যবহৃত হত শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং অশুভ আত্মার দূরীকরণে। এর পরে দীপাবলিতে বাজি ব্যবহারের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজি নিয়ে মাতামাতি করলেও এর কুফল নিয়ে চিন্তিত নয়। বাজির জ্বলনে নাইট্রাস অক্সাইড দীর্ঘ সময় বায়ুমণ্ডলে থেকে বাতাস দূষিত করে। যা শুধু ভারী বৃষ্টি ও প্রবল ঝড়েই পরিশুদ্ধ হয়। কিন্তু, এ নিয়ে কেউ ভাবেন না। এ ছাড়া, বাজিতে ব্যবহৃত তামা হৃৎপিণ্ডে প্রদাহ তৈরি করে ও ক্যাডমিয়াম রক্তে অক্সিজেন সরবরাহে বাধা দেয়। জ়িঙ্ক বা দস্তার জন্য বমি ও প্রবল জ্বর হতে পারে, সিসা স্নায়ুর ক্ষতি করে। যে দিন বিস্ফোরণ হল, সে দিন এবং তার পরের দিনও ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে। তাতে বাতাসে বারুদের গন্ধ কাটেনি। আসলে এই এলাকার মানুষের এমন ভাবে থাকাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’’
পরিবেশবিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এবং সালফারের বিভিন্ন যৌগ দিয়ে বাজি তৈরির কাজ চলে। বাজি তৈরির সময়ে মানবদেহের যা ক্ষতি হয়, সেটা বাজি পোড়ানোর ক্ষতির চেয়ে কম কিছু নয়।" এই প্রসঙ্গেই বক্ষরোগ চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "ঘুপচি, ছোট ঘরে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এমন বাজি তৈরির কাজ চলে। টানা রাসায়নিক যেতে থাকায় ফুসফুসের ক্ষতি হবেই। কমবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বাড়বে বুকের বিভিন্ন সংক্রমণ। ছোটদের উপরে এর প্রভাব আরও বেশি। যেহেতু একটা বয়সের পরে ফুসফুস পরিণত হয়, তাই অপরিণত ফুসফুসে লাগাতার এমন রাসায়নিক ঢোকার ফল হয় আরও মারাত্মক। এ নিয়ে পদক্ষেপ করার বা আলোচনা করার মতো লোক কোথায়?’’
চর্মরোগ চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ী বলেন, "কোনও বাজি তৈরির কারখানাতেই শ্রম আইন মেনে কাজ হয় না। যে কোনও একটি বছরে এই ধরনের এলাকায় যত বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই পরিসংখ্যান দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাজি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্তদের মারাত্মক ধরনের ঘা হতে পারে, চামড়ার পাকাপাকি ক্ষতি হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে।" চক্ষু চিকিৎসক জ্যোতির্ময় দত্ত আবার বললেন, "বাজি তৈরির সঙ্গে যুক্তদের চোখে অ্যালকালি বা অ্যাসিড বার্নের ঝুঁকি প্রবল। গরম এবং ধাতব যৌগ চোখে গিয়ে ভীষণ ক্ষতি করতে পারে। তবে সব চেয়ে বড় ঝুঁকি রাসায়নিকের ব্যবহার। দৃষ্টিশক্তিও সম্পূর্ণ ভাবে হারাতে হতে পারে।’’
চম্পাহাটির বেগমপুরের সরু রাস্তা ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে দেখা হল বছর উনিশের সুজাতা দাসের সঙ্গে। বিকেলে বাড়ির উঠোনে একাই বসে ছিলেন তিনি। বছর দুয়েক আগে বাজির কারখানায় বিস্ফোরণে শরীরের অনেকটা অংশ জ্বলে গিয়েছিল সুজাতার। এম আর বাঙুর হাসপাতালের বার্ন ইউনিট সে যাত্রায তাঁকে বাঁচায়। কিন্তু চোখটা শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। সুজাতা বলেন, "অন্য কিছু করে খাওয়ার মতো অবস্থাও আর নেই। এখন এখানকার বারুদের বিষেই শ্বাস নিতে হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy