খানাবেড়িয়ায় স্কুলের সামনেই বসে স্কুলছুট কিশোরেরা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
ভরদুপুরে পাড়ার মোড়ে বসে কয়েক জন কিশোর। কারও বয়স ১২, কেউ ১৩ বা ১৫ বছরের। এ সময়ে তো ওদের স্কুলে থাকার কথা! কী করছে এখানে? জানা গেল, ওরা এখন আর কেউ স্কুলে যায় না। স্কুলজীবনকে পিছনে ফেলে তারা এখন কেউ বাসের খালাসি, কেউ বা দোকানে দোকানে জিনিসপত্রের জোগান দেয়। কেউ ধাপার মাঠে আবর্জনার মধ্যে দামি জিনিসের খোঁজে যায়।
শুধু ওই কয়েক জন কিশোরই নয়। কলকাতার বুকে ধাপার আবর্জনার পাহাড়ের পিছনে লুকিয়ে থাকা ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের খানাবেড়িয়ার প্রায় প্রতিটি ঘরের কিশোরেরই স্কুলজীবনের পাট চুকেছে। ২০১৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একাদশ শ্রেণির পরে ১৩ লক্ষ পড়ুয়ার আর হদিস নেই। এরা কি সকলেই স্কুলছুট? খানাবেড়িয়া এফ পি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘১৩ লক্ষ তো গোটা রাজ্যের হিসাব। আমাদের এখানে পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা ৫০ জনের মধ্যে ৪০ জনই মাধ্যমিক দেয় না। এরা সকলেই স্কুলছুট। না হলে মাধ্যমিক দেবে না কেন?’’ প্রশ্ন জাগে, খাস কলকাতা সংলগ্ন খানাবেড়িয়া জনপদেই যদি স্কুলছুট পড়ুয়াদের সংখ্যা এত বেশি হয়, তা হলে গ্রামাঞ্চলে এই চিত্রটা কেমন?
স্কুল যাওয়ার বদলে কী করে কিশোরেরা? পাড়ায় বসে থাকা, বছর পনেরোর তুষার মণ্ডল বলে, ‘‘টুরিস্ট বাসে খালাসির কাজ করি। কাজ পেলে সে দিন ৫০০ টাকা আয় হয়।’’ রাজেশ প্রামাণিক নামে আর এক কিশোর বলে, ‘‘আমি হোটেলে ফাইফরমাশ খাটি। দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা।’’ তবে রাকেশ মণ্ডল, সুশান্ত মণ্ডল, শান্তনু দলুইরা একযোগে জানায়, ‘‘এর মধ্যে সব থেকে বেশি আয় হয় ধাপার আবর্জনায় জিনিস খুঁজতে গেলে। ঝুঁকি নিয়ে দিনভর আবর্জনা ঘেঁটে লোহালক্কর থেকে শুরু করে যা পাওয়া যায়, তা বিক্রি করে অনায়াসে ১০০০-১২০০ টাকা আয় হয়ে যায়।’’ আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ওই আবর্জনার পাহাড় থেকেই হাতে উঠে আসে দামি জিনিস, টাকা বা গয়না।
তবে কি শুধুই কাঁচা টাকা উপার্জনের ঝোঁকেই স্কুলজীবনে ইতি টানছে কিশোরেরা?
স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে অভিভাবকেরা মনে করেন, স্কুলছুটের কারণ শুধুই টাকা উপার্জন নয়। খানাবেড়িয়া এলাকায় উচ্চ প্রাথমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থাকলে এই প্রবণতা অনেকটা আটকানো যেত বলে মনে করেন তাঁরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, খানাবেড়িয়া থেকে চৌবাগা হাইস্কুলের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার। পড়ুয়াদের সেখানে পৌঁছতে হেঁটে অথবা সাইকেলে যেতে হয়। চিংড়িঘাটার কাছে সুকান্তনগর হাইস্কুলে যাতায়াতের দৈনিক খরচ ৩০ টাকা। প্রতিদিন যাতায়াতের পিছনে এত টাকা খরচ করা অনেকেরই সাধ্যের বাইরে।
খানাবেড়িয়া প্রাথমিক স্কুলে আবার সাপের উপদ্রব লেগেই থাকে। বর্ষাকালে যখন তখন চন্দ্রবোড়া সাপের দেখা মেলে। স্কুলশিক্ষকেরা মোবাইলে তোলা ছবিতে দেখালেন, কী ভাবে স্কুলের টেবিলে রাখা গ্লোবের পাশে উঁকি মারছে চন্দ্রবোড়া সাপ। এমনকি, তৃতীয় শ্রেণির ক্লাসঘরের দরজার ফাঁকে, মিড ডে-মিলের রান্নাঘরের জানলাতেও চন্দ্রবোড়া সাপের দেখা মিলেছিল। ধাপার আবর্জনার পাহাড়টাও দেখা যায় স্কুলবাড়ির ছাদে দাঁড়ালে। জঞ্জালের গন্ধ মাঝেমধ্যে ঝাপটা মারে স্কুলের বারান্দায়, ক্লাসঘরে। করোনার সময়ে ধাপায় যেখানে কোভিড আক্রান্তদের দেহ পোড়ানো হত, সেই জায়গাটাও স্কুল থেকে অস্পষ্ট দেখা যায়।
তবুও ওই প্রাথমিক স্কুলে প্রাক্ প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট পড়ুয়া সংখ্যা ২২২ জন, শিক্ষক ১৪ জন। তেতলা স্কুলের ক্লাসঘরে রং করা হয়েছে, দেওয়ালে নানা শিক্ষামূলক ছবি আঁকা। পড়ুয়াদের খেলাধুলোর সরঞ্জাম রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে চলছে মিড ডে-মিলও। পানীয় জলের ব্যবস্থাও আছে স্কুলে। প্রাথমিক স্কুলের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল স্কুলছুট কয়েক জন কিশোর। তাদের এক জন রাজেশ মণ্ডল বলে, ‘‘এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরে ফের হাইস্কুলে ভর্তি হই। কিন্তু সেখানে পড়া না পারলে শিক্ষকেরা বকাবকি করতেন, মারতেন। এত দূর থেকে বড় স্কুলে গিয়ে পড়ায় মন বসাতে পারিনি।’’
রাজেশের মতো অনেক পড়ুয়াই প্রশ্ন তুলছে, খানাবেড়িয়াতেই কেন উচ্চ প্রাথমিক স্কুল হবে না? কিশোরদের মায়েরা জানালেন, তাঁদের স্বামীদের বেশিরভাগই পেশায় মৎসজীবী। অথচ এলাকার আশপাশের ভেড়িতে মাছের চাষ ভাল না হওয়ায় উপার্জন কমেছে। তাই প্রতিদিন ৩০ টাকা অটোভাড়া দিয়ে ছেলেমেয়েদের দূরের স্কুলে পাঠানো কঠিন। সমগ্র শিক্ষা মিশনের চেয়ারম্যান কার্তিক মান্না বলেন, ‘‘ওই এলাকায় জমি খুঁজছি। ওখানে পুরোটাই সরকারি জমি। উপযুক্ত জমি পেলে ওখানে উচ্চ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের স্কুল করা হবে।’’
কিন্তু কবে? অপেক্ষায় কত দিন থাকতে হবে? সেই ফাঁকে খানাবেড়িয়ায় কি বাড়বে স্কুলছুট কিশোরের সংখ্যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy