শুরু হল পোস্তা সেতু ভাঙার কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টির দুপুরে গাড়ি থেকে নামলাম গণেশ টকিজ মোড়ে। এ দিক ও দিক রাস্তার জল বাঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম এক বহুতলের দিকে। সামনে ছাদহীন পোস্তা ফ্লাইওভার। ভাল নাম বিবেকানন্দ উড়ালপুল।
মঙ্গলবারের মতো ৫ বছর আগেও এখানে এসেছিলাম। তবে গাড়িতে নয়, গিরিশ পার্ক থেকে ছুটে। সে দিনও ফ্লাইওভারের ছাদ ছিল না। তবে পার্থক্য একটাই, ওই দিন ফ্লাইওভারের ছাদটা পড়ে ছিল রবীন্দ্র সরণির উপর। অভিশপ্ত বিশাল বিশাল চাঙড়ের নীচে চাপা পড়ে ছিলেন অসহায় সহনাগরিকরা। আজ সেই রাস্তায় পোস্তা বাজারের ভিড়। আতঙ্ককে পিছনে ফেলে পোস্তা ফ্লাইওভারের নীচে দিয়ে গাড়ি ছুটছে।
২০১৬ সালের ৩১ মার্চ। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে পোস্তা ফ্লাইওভার। নিমেষে থমকে গেল ব্যস্ত গণেশ টকিজ। পুলিশের ওয়াকিটকিতে শুধুই উড়ালপুল ভেঙে পড়ার খবর পাঠানো হচ্ছে। স্থানীয় মানুষ বিস্ময় কাটিয়ে উদ্ধার কাজে লেগে পড়েছেন। শহরের অ্যাম্বুল্যান্সের গন্তব্য তখন গণেশ টকিজ। ফায়ার ব্রিগেড থেকে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী— সকলেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। রাস্তার পাশের দোকানদারের ঘটনার প্রাথমিক রেশ কাটিয়ে কেউ দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার কেউ নিজের দোকানে আহতদের সেবা শুরু করে দিয়েছেন। যদিও কিছু ক্ষণের মধ্যেই এই দোকানগুলোই এক একটা কন্ট্রোলরুম হয়ে উঠেছিল।
এর আগে উল্টোডাঙা উড়ালপুল ভেঙে পড়ার খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছি। কিন্তু পোস্তা ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিলাম। রাস্তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে দৈত্যের আকারের স্ল্যাব পড়ে আছে। হেঁটে রাস্তার এ দিক থেকে ও দিকে যাওয়ার উপায় নেই। স্থানীয় এক জন সতর্ক করে দিয়েছিলেন ভুলেও চাঙড়ের উপর উঠবেন না। ভিতরে মানুষ চাপা পড়ে আছে। সত্যিই তাই। চাঙড় সরিয়ে আহতদের উদ্ধার করা হচ্ছে। ভিতর থেকে আর্তিও ভেসে আসছে। স্থানীয় অনেকে চাঙড়ের ভিতরে আহতদের খোঁজার চেষ্টা করছেন। আটকে থাকা যদি কেউ জল চান, তাই জলের বোতল হাতে আহতদের খোঁজ চালাচ্ছেন তাঁরা।
উদ্ধারকারী দলের সংখ্যা বাড়ছিল। তখনও ভিতরে কত জন চাপা পড়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে না। মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যাম। যোগাযোগও করা যাচ্ছে না কোথাও। তত ক্ষণে রবীন্দ্র সরণি থেকে পোদ্দার কোর্টের দিকে যাওয়ার রাস্তায় চলে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিচ্ছেন। দুপুরের দিকে উদ্ধারকাজে হাত লাগায় সেনা বাহিনীও। পোস্তা ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তত ক্ষণে। স্বজনহারা পরিবারেরা এসে পৌঁছেছেন। লালবাজার যাওয়ার দিকে রবীন্দ্র সরণিতে তখন নিহতদের নাম-ঠিকানা লিখে তালিকা তৈরি হচ্ছে। তারই মাঝে নিঁখোজদের পরিবারের অনেকেই চলে এসেছেন গণেশ টকিজ মোড়ে। সবাই তখন উদ্ধারে হাত লাগাতে চাইছেন। চাঙড়ের কাছে কান পেতে শুনতে চাইছেন ভিতর থেকে কোনও ডাক আসছে কি না।
হাওড়ার দিক থেকে আসতে ৩৯ নম্বর পিলার থেকে গিরিশ পার্কের দিকে ৪১ নম্বর পিলারের মাঝের অংশ ওই দিন ভেঙে পড়ে। মাঝের ৪০ নম্বর পিলারের অর্ধেকটা অংশ এখনও রয়েছে। এক বহুতলের ছাদ থেকে পাখির চোখে ঘটনাস্থল দেখেছিলাম সে দিন। নীচে চলা উদ্ধারকাজও। সাইরেন বাজিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স আসছে আর আহতদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। যদিও ওই পরিস্থিতিতে কে আহত আর কে নিহত, সে বিচারের সময় উদ্ধারকারীদের কাছেও ছিল না।
পোস্তা উড়ালপুর যাতে আর কোনও দিন কারও উপর ভেঙে পড়তে না পারে সে জন্য মঙ্গলবার থেকে এই নির্মাণ ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করা হল। পোস্তা পেঁয়াজ মান্ডির সামনে ১২ নম্বর স্তম্ভের কাছে টিন দিয়ে ঘিরে ভাঙার কাজ চলছে। বামফ্রন্টের আমলে শুরু হয়েছিল পোস্তা উড়ালপুল তৈরির কাজ। ‘‘উড়ালপুলের শিলান্যাসের দিন ছিলাম। তারপর ৬-৭ বছর ধরে এই উড়ালপুল তৈরি হতে দেখলাম। ২০১৬ সালে ভেঙেও পড়ল চোখের সামনে। এ বার এত দিনের এই বিশাল নির্মাণকে ভাঙতে দেখব। একই উড়ালপুল তৈরি হতে আর ভাঙতে কেউ দেখেছি কি?’’— প্রশ্ন করলেন জোঁড়াসাকো কালিবাড়ির সেবায়েত কার্তিক ভট্টাচার্য।
উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পর কয়েক দিন ধরে চলে উদ্ধারকাজ। ৪০ নম্বর পিলারের কাছে লড়ির মধ্যে আটকে থাকা দেহ বার করে আনতে বেগ পেতে হয়েছিল উদ্ধারকারীদের। দুর্ঘটনার পরের দিন পোস্তার দিকের উড়ালুপলের হেলে পড়া অংশ ভেঙে পড়ার ভয় ছিল। তাই দ্রুত ওই অংশ ভেঙে ফেলতে চাইছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। কিন্তু উড়ালপুল ভাঙার অভিঘাতেই পাশের বাড়িগুলো ক্ষতি হয়েছে। পরের দিন গিয়ে দেখেছিলাম অনেক বাসিন্দাই ঘরছাড়া। প্রায় ২০ দিনের উপর তাঁদের বাড়ির বাইরেই কাটাতে হয়েছিল।
আগামী ৪৫ দিন ধরে চলবে পোস্তা উড়ালপুল ভাঙার কাজ। এক এক করে কেটে নীচে নামানো হবে বিভিন্ন অংশ। কিছু দিন পর পোস্তা উড়ালপুল মিলিয়ে যাবে। থেকে যাবে পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে পড়ার স্মৃতি। আরও কয়েক বছর পর কোনও বৃষ্টির দিনে গণেশ টকিজ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির মধ্যে থেকে কেউ হয়তো তাঁর সন্তানকে একটা উড়ালপুলের গল্প শোনাবেন। মানুষের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে পোস্তা উড়ালপুল। জানি না পোস্তা উড়ালপুলের স্মৃতিতে কোনও ফলক থাকবে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy