৮ জুলাই, ২০১৫। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ আচমকাই হরিদেবপুরের কবরড়াঙা মোড়ের একটি পানশালার সামনে এলোপাথাড়ি চলতে শুরু করল গুলি ও বোমা। পুলিশের একাংশের দাবি, অন্তত ৩৫ রাউন্ড গুলি চলেছিল সেদিন। গুলিতে মৃত্যু হয় রাহুল মজুমদার ওরফে রাজা (২৪) নামে এক যুবকের। জখম হন দুই অটোচালক।
পুলিশ সূত্রে খবর, ওই দিন রাত দশটা নাগাদ পানশালাটিতে এক দল যুবক গায়িকা-নর্তকীদের সঙ্গে নাচগান করতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে পানশালার বাউন্সারদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় ওই যুবকেরা। সামনের কিয়স্কে দু’জন পুলিশ ও এলাকায় মোটরবাইক টহল রাখা হয় বলে পুলিশকর্তাদের দাবি। এরপরই ফের কয়েকটি অটোয় চেপে এসে দুষ্কৃতীরা এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। ঘটনার সময়ে সামনের পুলিশ কিয়স্কে পুলিশকর্মীরা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা লুকিয়ে পড়েছিলেন বলে অভিযোগ।
বড়দিন বা নববর্ষের উদযাপন খুব একটা বেশি দূরে নয়। পুলিশ তৈরি হচ্ছে উৎসবের মরসুমে জনগণকে সামলানোর জন্য। বিশেষ নজরদারি থাকে শহরের পানশালাগুলিতেও। লালবাজার সূত্রে খবর, কলকাতা পুলিশের নিয়ম অনুযায়ী ২০১৪-র নভেম্বরে একটি নির্দেশিকা জারি করে আবগারি দফতরের লাইসেন্স ছাড়াও পানশালা ও রেঁস্তোরা চালাতে গেলে পুলিশ লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। বাধ্যতামূলক করা হয় পানশালার বাইরে সিসিটিভি লাগানোও। গানের আসরের ব্যবস্থা থাকলে গায়ক-গায়িকাদের নিতে হয় 'ক্রুনার লাইসেন্স' (পানশালায় গানের জন্য লাইসেন্স)।
তবে নিষিদ্ধ হলেও যেমন এ শহরে নাচের আসর বসে, তেমনি বহু পানশালার গায়ক-গায়িকাদের ক্রুনার লাইসেন্সও নেই বলে অভিযোগ। শহরের অধিকাংশ পানশালার বাইরেও সিসিটিভি অনুপস্থিত। রাস্তার ধারে আবগারি দফতরের অনুমতি নিয়ে পুলিশি লাইসেন্স ছাড়াই রয়েছে একাধিক পানশালা। প্রতি বারই উৎসবের মরসুমের আগে পানশালা এবং পানশালার গায়িকাদের লাইসেন্সের ব্যাপারে খতিয়ে দেখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও শেষপর্যন্ত যে কিছুই করা হয় না, তা নিয়ে বরাবরের ক্ষোভ পুলিশের একাংশের মধ্যেই।
শহরের পানশালাগুলিকে ঘিরে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ উঠে আসে। সম্প্রতি পর পর রিজেন্ট পার্ক, বাঁশদ্রোণী, যাদবপুর-সহ বিভিন্ন চুরির ঘটনাতেও অপরাধীদের সঙ্গে পানশালার নর্তকীদের যোগাযোগের কথা উঠে এসেছে। বিভিন্ন পানশালার সঙ্গে নারী পাচারচক্রের হাত থাকে বলেও পুলিশের একটি সূত্রের দাবি। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রেই থাকে সিণ্ডিকেট ব্যবসা থেকে কাঁচা টাকার জোগান।
প্রতি বছরের মতই এ বছরও ১৭ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সমস্ত ডেপুটি কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন লালবাজারের শীর্ষকর্তারা। ফের জোর দেওয়া হয় পানশালার বাইরে সিসিটিভি-র ফুটেজ খতিয়ে দেখা থেকে শুরু করে শব্দদূষণ আটকানো, পানশালা আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কোনও বেনিয়ম দেখলেই ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে। কড়া নজর রাখতে বলা হয় গোয়েন্দা বিভাগকে এবং পুলিশের লাইন্সেস বিভাগকেও। কিন্তু এর বাইরে যে তাঁদের আর কিছুই করার নেই, তা ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিচ্ছেন বহু পুলিশকর্তাই।
কিন্তু কেন সব বুঝেও পানশালার বিষয়ে গা-ছাড়া মনোভাব পুলিশের? পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাসক দলের চাপেই তারা ব্যবস্থা নিতে পারে না। অন্য দিকে, পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে এ ধরনের বিভিন্ন পানশালার সঙ্গে নানা রকম 'লেনদেন'-এর অভিযোগ। ‘‘নজরদারি থাকলেও অনেক সময়ে স্থানীয় থানাগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেওয়ায় তা উপরতলায় এসে পৌঁছয় না’’-অভিযোগ লালবাজারের এক কর্তার।
এর মধ্যেই সম্প্রতি বিধাননগরের পুলিশ সেখানকার পানশালাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে পানশালাগুলির মালিকদের সংগঠন। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তারা। ২ ডিসেম্বর ওই মামলার শুনানিতে পানশালা মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়, পানশালা সংক্রান্ত যাবতীয় আইন আবগারি দফতরের বিধি মেনে তৈরি। আবগারি আইনে পানশালাগুলির উপরে পুলিশের নজরদারির কথা বলা নেই। প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসন বা আবগারি দফতরে যাবতীয় নথি দাখিল করবে পানশালাগুলি।
বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত জানান, তিনি দু’পক্ষের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কয়েক দিনের মধ্যে একটি নির্দেশিকা তৈরি করে দেবেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনও নির্দেশিকা জারি হয়নি। কিন্তু কলকাতা পুলিশকর্তাদের আশঙ্কা, পানশালা মালিকদের দাবি মান্যতা পেলে অদূর ভবিষ্যতে পুলিশের হাত থেকে সামান্য রাশটুকুও চলে যাবে।
তাই, ফের যে কোনও দিন হরিদেবপুরের পুনরাবৃত্তি দেখতেই পারে কলকাতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy