জয় গোস্বামী। ছবি: সংগৃহীত।
সম্প্রতি কবিতা প্রকাশ বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন জয় গোস্বামী। তিনি তাঁর কবিতা প্রকাশের ৫০ বছর পুর্তি হওয়ার বছরেই এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় বাংলা কবিতা জগতে এক নজির সৃষ্টি হল বলে মনে করছেন কবি, পাঠক থেকে কাব্য-আলোচকেরা। এর আগে কবি সমর সেন মাত্র ১২ বছর কাব্যচর্চার পর বন্ধ করে দেন কবিতা লেখা। পঞ্চাশের দশকের সম্ভাবনাময় কবি তন্ময় দত্তও লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সব ঘটনার মধ্যে কোনও ‘ঘোষণা’ ছিল না। জয় তাঁর এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন একটি পুস্তিকায়। ‘কবিতা প্রকাশের ৫০ বছরে’ নামের এই পুস্তিকাটির প্রকাশকাল হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে ‘ক্রীসমাস, ২০২৩’। পুস্তিকাটির কোনও বিক্রয়মূল্য নেই। সমাজমাধ্যমে পুস্তকাটির প্রকাশক অভিরূপ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কয়েকটি বই-বিপণি থেকে আগ্রহীরা বিনামূল্যেই সংগ্রহ করতে পারবেন পুস্তিকাটি।
কবিতা প্রকাশের ৫০ বছরে এসে কবি কেন সিদ্ধান্ত নিলেন কাব্যপ্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার? আনন্দবাজার অনলাইনকে কবি জানান, তাঁর এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিত এবং কারণগুলি তিনি পুস্তিকাটিতেই লিখেছেন। কী লিখেছেন তিনি এই ২৩ পৃষ্ঠাব্যাপী গদ্যে?
ওই পুস্তিকায় জয় লিখেছেন তাঁর কবিতা রচনা ও প্রকাশের প্রাথমিক দিনগুলির কথা। তার পরে এসেছেন এমন কিছু কবির প্রসঙ্গে, যাঁরা একটা সময়ের পরে তাঁদের লেখার মূল দীপ্তি থেকে সরে এসেছিলেন বা সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। সমান্তরালে তেমন কবিদের কথাও লিখেছেন, যাঁরা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বদলে নিয়েছেন কবিতার বাঁক, নতুন প্রভায় উজ্জ্বল করে তুলেছেন তাঁদের কলমকে। প্রসঙ্গক্রমে জয় উদাহরণ দিয়েছেন তাঁর প্রিয় বিষয় ক্রিকেট দুনিয়া থেকেও। বলেছেন, পরিণত বয়সে ডন ব্র্যাডম্যানের খেলার কৌশল বদলের কথা। কিন্তু তাঁর মতে ব্র্যাডম্যান বা কবি অরুণ মিত্র ব্যতিক্রম। তাঁর কথায়, “ব্যতিক্রমকে অনুসরণ করা আত্মহত্যার নামান্তর”। জয় জানিয়েছেন, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো কবির প্রতিভার তুলনায় তাঁর ক্ষমতা সীমিত। তাঁদের শেষ বয়সের লেখায় যে ‘অগ্নিহারা’ দশা দেখা দিয়েছিল, তা তাঁর সামনে এক কঠিন সত্যকে তুলে ধরে। কখনও পুরাণের কাহিনি তুলে ধরে, কখনও বা ইতিহাসের পাতা থেকে ‘ক্ষয়’-এর উদাহরণ তুলে ধরে জয় দেখাতে চেয়েছেন, “এক হিটলার আমাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে।” যে নিজের সব কিছু প্রাপ্তির পরে অন্যের সর্বস্ব দাবি করে। তাঁর প্রশ্ন, সাহিত্যজগৎ থেকে আর কিছু চাওয়া তাঁর পক্ষে কতখানি সঙ্গত?
সম্প্রতি ৭০ বছরে পা রেখেছেন জয়। তাঁর ধারণায় কিছু ‘মুদ্রণউপযোগী’ পঙ্ক্তি কবিতার নামে তিনি ছাপিয়েছেন, বহু সন্ধানের পরেও নিজস্ব কাব্যভাষা তিনি পাননি। তাই নিজেকে খোঁজার, নিজস্ব নিভৃতিতে বসে কাব্যরচনার প্রয়াস নেওয়ার সময় এখন। লেখা প্রকাশের বাসনা থেকে নিবৃত্তি নিয়ে শুধু লেখার উত্তেজনাকে জাগিয়ে রাখা সম্ভব কি না, সেই নিরীক্ষায় তিনি প্রবেশ করতে চান।
এর বাইরে, আরও একটি বিষয়ের কথা লিখেছেন জয়। রাজ্য সরকার তাঁকে বঙ্গভূষণ ও বঙ্গবিভূষণ সম্মান প্রদান করেছে। পেয়েছেন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট। এর পর থেকে যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁর অনুরোধ, তাঁরা যেন আর কোনও পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বিবেচনা না করেন।
ফোনালাপের সময়ে জয় জানালেন, ২০২২-এর মার্চ থেকে ২০২৩ জুড়ে তাঁর ১৫টি কাব্যপুস্তিকা এবং তিনটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার পরেই এই ঘোষণা। এর পর কবি নীরব। ১৮টি কাব্যগ্রন্থকে দ্রুত প্রকাশ করেই কি বাণপ্রস্থকে বেছে নিচ্ছেন? জয়ের শেষতম কাব্যপুস্তিকাটির নাম ‘বাণপ্রস্থ’। সেটিও কি এই ঘোষণার পুর্বাভাস ছিল? উল্লেখ্য, জয়ের প্রথম প্রকাশিত কাব্যপুস্তিকাটির নাম ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’। আর এই পুস্তিকা প্রকাশের কাল হিসেবেও ‘ক্রিসমাস’-এর উল্লেখই রয়েছে। পাতাঝরার মরসুমে এক দিন আত্মপ্রকাশ করেছিলেন কবি। আর এক ঝরাপাতার দিনগুলিতে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেলেন ‘ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা?’র কবি। কবিতা প্রকাশ না করলেও তিনি যে কাব্যচর্চায় সক্রিয় থাকবেন, তার আশ্বাস এই পুস্তিকাতেই রয়েছে। কিন্তু এক দিন তো শীত শেষ হয়! জীর্ণপাতা ঝরার বেলা ফুরিয়ে আবার গাছে গাছে বসন্ত নেমে আসে। তাঁর অনুরাগীরা কি সেই আশাতেই বুক বাঁধছেন? সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন পোস্ট অন্তত সেই কথাই বলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy