পরিবার সূত্রে দাবি গাড়ির মধ্যে পাওয়া গিয়েছে 'বুলেট হেড'।
নবমীর শেষ রাতে নিমতার বঙ্কিম মোড়ে গাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল দমদমের বাসিন্দা দেবাঞ্জন দাসের দেহ। ওই তরুণের পরিবার প্রথম থেকেই দাবি করছিল, দেবাঞ্জনকে খুন করা হয়েছে। এবং তার পিছনে ত্রিকোণ প্রেমের কোনও রহস্য থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ জানিয়েছিল, গাড়ি দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে বছর কুড়ির ওই তরুণের। পুলিশ পরিবারের সেই অভিযোগ নিতে চায়নি। তবে, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট খুনের সম্ভাবনাকেই জোরালো করছে। আর গোটা ঘটনায় পুলিশেরই চূড়ান্ত গাফিলতি উঠে এসেছে।
পুলিশ সূত্রে খবর, বুধবার বিকেলেই দেবাঞ্জনের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট হাতে পেয়েছে তারা। সেখানে ওই তরুণের দেহে দু’টি ফুটোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি তাঁর ঘাড়ের বাঁ দিকে । অন্যটি, ডান হাতের কনুইয়ের কাছে। গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে শরীরে যে ধরণের আঘাত থাকার কথা, তেমন কোনও কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলেই জানা গিয়েছে পুলিশ সূত্রে। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পর ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের শীর্ষ এক আধিকারিক বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘দেবাঞ্জনের দেহে ওই ফুটো দু’টি গুলি লেগেই হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। পুরোটা খতিয়ে দেখছি।” তা হলে প্রথমেই কেন তাঁরা দাবি করেছিলেন, গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে! এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি ওই আধিকারিক। এমনকি, ঘটনাস্থলে তদন্তে যাওয়া এএসআই গৌতম ঘোষ নিমতা থানার ওসিকে যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছিলেন, সেখানে গুলির কোনও উল্লেখই করেননি তিনি। উপরন্তু তিনি লিখেছিলেন, দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয়েছে। এর পিছনে রহস্যজনক কিছু পাওয়া যায়নি বলেও লিখেছিলেন করেছিলেন তিনি।
মৃতের বাবা অরুণ দাস যদিও দাবি করেন, এএসআই গৌতম ঘোষের সামনেই তাঁরা গাড়ির ভিতরে বুলেটের টুকরো খুঁজে পান। গৌতমবাবুকে তা বলায়, তিনি সেটি সংগ্রহের জন্য তাঁদের একটি ‘সার্জিক্যাল গ্লাভস’ কিনে আনতে বলেন। তার পরেও কেন রিপোর্টে সে কথা উল্লেখ করলেন না গৌতমবাবু, তার কোনও জবাব মেলেনি। পুলিশ সূত্রে খবর, থানার ওসি শিবু ঘোষের নির্দেশেই রিপোর্টে ওই বুলেটের টুকরোর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ দিন পুলিশ কমিশনার নিমতা থানায় গিয়ে গোটা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ওসি-র বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্রের খবর, পুলিশ কমিশনার ওই আধিকারিকের ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
এর পরে অরুণবাবুরা যখন নিমতা থানায় গিয়ে খুনের অভিযোগ করতে চান, তখন তা নিতে অস্বীকার করে পুলিশ। মৃত ওই তরুণের পরিবারের কোনও অভিযোগ নিতে চাইছে না— বিষয়টা বুধবার প্রকাশ্যে আসার পরই রাতে নিমতা থানায় যান ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা এবং ডিসি (জোন২) আনন্দ রায়। তাঁরা থানার আধিকারিক এবং ঘটনার দিন যে পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে প্রথমে পৌঁছেছিলেন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।বৃহস্পতিবারও ডিসি-কে সঙ্গে নিয়ে ফের বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ নিমতা থানায় যান কমিশনার। যে গাড়ি থেকে দেবাঞ্জনের দেহ উদ্ধার হয়েছিল, সেটি তিনি ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেন। পুলিশ সূত্রে খবর, এর পরেই দ্রুত খুনের মামলা শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন কমিশনার। গাড়িটির ফরেন্সিক পরীক্ষারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।পুলিশের তরফে যে গাফিলতি হয়েছে, কার্যত সে কথা মেনে নিয়েছেন ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা। মনোজএ দিন বলেন, ‘‘থানা কেন খুনের অভিযোগ নেয়নি সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি গোটা ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।’’ কমিশনারের নির্দেশের পর এ দিন দুপুরে ঘটনার ১০ দিন পর ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের মামলা রুজু করে পুলিশ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
আরও পড়ুন: গাড়িতে গুলির টুকরো, দমদমে তরুণের রহস্য মৃত্যু, পিছনে ত্রিকোণ প্রেম?
নবমী অর্থাৎ গত ৭ অক্টোবর রাত পৌনে তিনটে নাগাদ দমদম ৪ নম্বর রেল গেট এলাকার বাসিন্দা, ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া দেবাঞ্জন দাসকে তাঁরই সেডান গাড়িতে মৃত অবস্থায় পায় পুলিশ। নিমতা বঙ্কিম মোড় থেকে ওই রাতে দেবাঞ্জনের দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছিল,চালকের আসনে ছিলেন ওই তরুণ। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ দাবি করে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে দেবাঞ্জনের। কারণ গাড়ির সামনে বাঁদিকের হেডলাইটের অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। পাশের পাঁচিল এবং একটি ল্যাম্পপোস্টে যে গাড়িটি ধাক্কা মেরেছিল, তারও প্রমাণ মেলে বলে জানিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু বছর কুড়ির দেবাঞ্জন দাসের রহস্যমৃত্যু নিয়ে প্রথম থেকেই তার পরিবার খুনের অভিযোগ করছিল। পুলিশ যদিও তা শুনতে নারাজ ছিল, এমনকি খুনের অভিযোগটা পর্যন্ত নেয়নি নিমতা থানা। এমনটাই দাবি দাস পরিবারের।
দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করা হয় পুলিশের রিপোর্টে। উল্লেখ নেই গুলির কথা।
আরও পড়ুন: হাওয়ার চাপে বেঁকেছে টালা ট্যাঙ্কের দেওয়াল
কিন্তু পুলিশের দুর্ঘটনার তত্ত্ব ধাক্কা খায়, যখন ওই গাড়ি থেকে দেবাঞ্জনের পরিবার একটি ‘বুলেট হেড’ খুঁজে পান এএসআই গৌতম ঘোষের উপস্থিতিতে। পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, খুন করা হয়েছে দেবাঞ্জনকে। ওই তরুণের বাবা অরুণ দাস পুলিশকে জানান যে, দেবাঞ্জন নিমতা সর্দার পাড়ার এক তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তা নিয়ে ওই তরুণীর প্রাক্তন প্রেমিক প্রিন্স সিংহ নামে এক যুবক বেশ কয়েকবার দেবাঞ্জনকে ফোনে হুমকি দিয়েছিলেন।সেখান থেকেই মৃত তরুণের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়, দেবাঞ্জনের মৃত্যুর পিছনে রয়েছে ত্রিকোণ প্রেম। কিন্তু বুধবার পর্যন্ত পুলিশ সেই অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে।
গোটা ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রাক্তন এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘ঘটনা পরম্পরা দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে এখানে পুলিশের একটা বড়সড় গাফিলতি রয়ে গিয়েছে। এক জনের দেহ গাড়ি থেকে উদ্ধারের সময় কোনও পুলিশ কর্মী খেয়াল করলেন না, তার দেহের কোথায় কী কী ক্ষতচিহ্ন রয়েছে? প্রাথমিক ভাবে তো তাঁদেরই দেখার কথা সেটা। মৃতের ঘাড়ে ও কনুইতে দুটো ফুটো রয়েছে, সেটা জানার জন্য ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল কেন, সেটা বুঝতে পারছি না। ওই ফুটো গুলি লেগে হয়েছে কি না সেটা যদিও তদন্তসাপেক্ষ।’’ তিনি আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মৃতের পরিবার দাবি করছে ওই গাড়ি থেকে তারা ‘বুলেট হেড’ পেয়েছে। কেন তাঁরা খুঁজে পেলেন? পুলিশ কেন পেল না? তবে কি গাড়িটা ভাল করে পরীক্ষাই করেননি তাঁরা?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy