Advertisement
২১ জানুয়ারি ২০২৫
History

‘আট হাত ধুতি, আড়াই হাত গামছা’ নিয়ে ঘটিতোলা লোক

নাট্যকার অমৃতলাল বসুর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ রয়েছে এই পেশার মানুষের কথা।

প্রাচীন: (১) ঊনবিংশ শতকের পাথরের ঘটি। (২) প্রায় দুশো বছর আগের ধাতব ঘটি। (৩) আড়াইশো বছরের পুরনো নকশা করা ধাতব ঘটি। ছবি: সাবর্ণ সংগ্রহশালার সৌজন্যে

প্রাচীন: (১) ঊনবিংশ শতকের পাথরের ঘটি। (২) প্রায় দুশো বছর আগের ধাতব ঘটি। (৩) আড়াইশো বছরের পুরনো নকশা করা ধাতব ঘটি। ছবি: সাবর্ণ সংগ্রহশালার সৌজন্যে

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৯:৩০
Share: Save:

‘‘এক সময়ে তো কুয়ো থেকে ঘটি তোলা একশ্রেণির মানুষের পেশা ছিল এ শহরে। হয়তো জল তুলতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে ঘটিটা পড়ে গেল কুয়োয়। কে তুলবে? অথচ সেটি ফিরে পাওয়াও প্রয়োজন। এ শহরে কাজের খোঁজে আসা অনেকে সে কাজই করতেন। ভোর না হতেই তাঁরা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ‘কুয়োর ঘটি তোলা’ হাঁক মেরে বেরিয়ে পড়তেন। তাঁদের নামই হয়ে যেত ঘটিতোলা অমুক।’’ হাসতে হাসতে বলছিলেন কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক।

নাট্যকার অমৃতলাল বসুর স্মৃতিচারণায় উল্লেখ রয়েছে এই পেশার মানুষের কথা। হরিপদবাবু জানালেন, স্মৃতিচারণায় রয়েছে কী ভাবে ওই পেশার মানুষ ‘কোমরে একখানি আট হাতি ধুতি, কাঁধে একখানি আড়াই হাত গামছা’ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তার পরে নেমে যেতেন পাতকুয়োয় পড়ে যাওয়া ঘটি তুলতে। তাঁর কথায়, ‘‘অমৃতলাল বসু তখন ছোট। পরিবারের বড় কারও সঙ্গে বেরিয়েছেন এক বিকেলে। হঠাৎই দেখা গেল, সকালে যিনি ঘটি তুলতে এসেছিলেন, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে পট বিক্রি করছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে, কী ব্যাপার পট বিক্রি করছেন? ওই ব্যক্তি উত্তর দিয়েছিলেন, এক বেলা ঘটি তুলে কি পেট ভরবে? তাই সকালে তিনি ঘটি তোলেন, অন্য সময়ে যখন যেমন কাজ পান, সেটাই করেন।’’

ঐতিহাসিক তথ্য সূত্রে জানা যায়, হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সময় থেকেই ঘটির ব্যবহার ছিল। যদিও এ শহরে ঘটির ব্যবহার ঠিক কবে থেকে, তার নিশ্চিত তথ্য দেওয়া মুশকিল বলেই জানাচ্ছেন গবেষকেরা। তবে মাটি থেকে কাঁসা, পিতলে বদলে যাওয়া ঘটির আকার ও নকশা জানিয়ে দেয় সময়ের বিপুল প্রবাহের সাক্ষী সে। আবার সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ভেদে এবং ব্যবহারের রকম ফেরে তৈরি হত নানা ধরনের ঘটি। কোনও ঘটিতে পুজোর জন্য গঙ্গাজল রাখা হত, আবার কোনও ঘটি জলপানের জন্যে ব্যবহার করা হত।

ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘সংস্কৃত শব্দে ঘট শব্দটি রয়েছে। আর ছোট ঘট হলে ঘটি। ক্ষুদ্রার্থ প্রত্যয় হচ্ছে ‘ই’। জল রাখা বা অন্য কিছু রাখার জন্য ঘট বা ঘটি।’’ কিন্তু ব্যবহারের মতোই শব্দগত দিক থেকেও এর উৎপত্তি সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যাবে না বলে জানাচ্ছেন তিনি। পবিত্রবাবুর কথায়, ‘‘অক্সফোর্ড অভিধানের মতো আমাদের তো সে রকম অভিধান নেই। তাই ঠিক কবে থেকে শব্দটি এসেছে, সেটা বলা যাবে না। তবে প্রাচীন তো বটেই।’’ শহরের সঙ্গে ঘটির সুপ্রাচীন সম্পর্ক অবশ্য এখন প্রায় বিস্মৃত। হরিপদবাবু বলছিলেন, ‘‘ঘটির ব্যবহার এখন আর কোথায় হয়! এ প্রজন্মের ক'জনই বা জানেন ঘটিতোলা লোকেদের কথা।’’

কিন্তু সেই ঘটি-স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে আগামিকাল, রবিবার থেকে বেহালার বড়িশায় শুরু হতে চলা এক উৎসবে। যেখানে ঐতিহাসিক অনেক সামগ্রীর পাশাপাশি কয়েক শতক ধরে সংগৃহীত ঘটিও প্রদর্শিত হবে। যার কোনওটি ৪০০, কোনওটি ২৫০ আবার কোনওটি ২০০ বছরের পুরনো। কোনও ঘটি তৈরি পাথর দিয়ে, কোনও ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে ধাতু, কোনও ঘটির উপরে আলাদা করে নকশা করা। তাদের ব্যবহারের ধরনও ছিল আলাদা, জানাচ্ছেন ওই উৎসবের উদ্যোক্তা ‘সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদ’-এর সম্পাদক দেবর্ষি রায়চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামগ্রী প্রদর্শনীর পাশাপাশি চার শতকব্যাপী আমাদের পরিবারের সংগৃহীত ঘটির প্রদর্শনীও করা হবে।’’

ফলে ঘটিতোলা-লোকেরা আর না-ই বা থাকলেন, অন্তত ঘটির স্মৃতিটুকুই থাক শহরবাসীর মনে।

অন্য বিষয়গুলি:

History Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy