Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

টালা সেতুর নীচ থেকে যেতে হবে, কিন্তু কোথায়?

উত্তম একা নন। ওই এলাকার ৭০-৭৫টি পরিবারই গত পুজো থেকে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার শিকার। অধুনা বিপজ্জনক ও ক্ষয়িষ্ণু বলে চিহ্নিত টালা সেতু যখন কাঠের, সে-ই তখন থেকে ওখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার।

টালা সেতুর নীচে ঘর ভাঙার কাজ চলছে। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

টালা সেতুর নীচে ঘর ভাঙার কাজ চলছে। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩২
Share: Save:

ভোটার কার্ডে সন্দেশখালির বেড়মজুর গ্রামের ঠিকানা! তবে মধ্য তিরিশের উত্তম দাস, তাঁর বাবা লক্ষ্মণবাবু— সকলের জন্ম এই টালা সেতুর নীচের পাড়ায়। ওই তল্লাটের কাশিমবাজার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রের দুশ্চিন্তা, ‘জবরদখলকারী’ তকমা সেঁটে আবার ঘর হারাতে হলে কী ভাবে চলবে ক্যানসারে কাহিল বাবার চিকিৎসা!

উত্তম একা নন। ওই এলাকার ৭০-৭৫টি পরিবারই গত পুজো থেকে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠার শিকার। অধুনা বিপজ্জনক ও ক্ষয়িষ্ণু বলে চিহ্নিত টালা সেতু যখন কাঠের, সে-ই তখন থেকে ওখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার। ৬০-৭০ বছরে পাকা ঘর, গ্যাস, বৈধ বিদ্যুতের লাইন, রেশন কার্ড— জুটেছে সবই। এখন টালা সেতুর সংস্কার উপলক্ষে সামনে নতুন করে ‘উদ্বাস্তু’ হওয়ার খাঁড়া! মহালয়ার সময় থেকে শুরু হয়েছিল সেতুর নীচের বাসিন্দাদের সরানো। সোমবার শুরু হয়েছে ঘরদোর ভাঙা। সেই কাজ করছে পূর্ত দফতর। একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দেখিয়ে পুলিশের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী, এখনও সেতুর নীচের বাড়িঘর না-ভাঙায় পূর্তমন্ত্রী ক্ষুব্ধ। কলকাতা পুরসভার এক নম্বর বরোর চেয়ারম্যান তরুণ সাহা দাবি করছেন, ‘‘সেতুর নীচের বাসিন্দারা আদতে জবরদখলকারী। অধিকাংশই সুন্দরবন এলাকার। একটা বড় অংশের আধার-ভোটার কার্ড থাকলেও তা স্থানীয় ঠিকানায় নয়।’’ তা হলে এত বছর ধরে কী ভাবে এখানেই থাকছেন এতগুলি মানুষ? তরুণবাবু মানছেন, ‘‘বহু বছর ধরে পুরনো রাজনৈতিক জমানায় স্থানীয় প্রশাসনের নজর এড়িয়ে তাঁরা কখন সংসার পেতে বসেছেন, খেয়ালই করা হয়নি।’’

আপাতত টালা সেতুর ভঙ্গুর দশা বেআব্রু হওয়ার পরে ওই চত্বরের বাসিন্দাদের অবস্থা খানিকটা বৌবাজারের দুর্গা পিতুরি, সেকরাপাড়া লেনের ‘ঘরহারা’দের সঙ্গে তুলনীয়। এ যাত্রা বিকল্প বাসস্থান হিসেবে হোটেলের প্রশ্ন নেই, তার বদলে জুটেছে প্লাস্টিকের ছাউনি। স্বরযন্ত্রের ক্যানসারে কাবু লক্ষ্মণবাবু সেই ঘরে বসেই এ দিন ইশারায় ছেলের কাছে খোঁজ নিচ্ছেন, সেতুর নীচে এত দিনের বাড়িটা এখনও আস্ত না কি ভেঙেই ফেলা হয়েছে। ওজন-যন্ত্র সারাইয়ের মিস্ত্রি, পুত্র উত্তম দিশাহারা। বলছেন, ‘‘ঝুপড়ির ঘরে অসুস্থ বাবাকে রাতে বাথরুম যেতে হলেও আমাদের মাথায় হাত পড়ে। রাত আটটায় পাশের শৌচালয় বন্ধ হয়ে গেলে যাওয়ার জায়গা নেই।’’ একই সমস্যা পাশের ঝুপড়ির সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা দীপালি হরির। খালপাড়ের ঝুপড়িতে উঠে আসার পরেই ডেঙ্গিতে কাবু হয়ে আর জি কর হাসপাতালে সাত দিন ভর্তি ছিল ১৩ বছরের স্কুলপড়ুয়া পীযূষ প্রসাদ। ‘‘খালধারের এত জঞ্জাল, খোলা নর্দমা, দিনে-রাতে মশার কামড় খাচ্ছি!’’— বলছেন তার দাদা প্লাস্টিক কারখানার মজুর গৌতম প্রসাদ।

ঘর হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে সেতুর নীচের বাসিন্দা লক্ষ্মণ দাস।

মাত্র কয়েক মাস হল, বিস্তর টানাপড়েনের পরে উত্তর কলকাতার ওই এলাকায় টালা পার্ক সংলগ্ন অজস্র ঝুপড়ির বেশ কয়েকটি পরিবারকে সরকারি নৈশাবাসে আশ্রয় দিয়েছেন তরুণবাবুই। পুর উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত সহায়তায় তাঁদের সাহায্য করা চলছে। টালা সেতুর নীচের বাসিন্দাদের নিয়ে বরো চেয়ারম্যানের বক্তব্য, ‘‘পাকা বাড়ি বা ক্ষতিপূরণ কাউকে দেওয়া সম্ভব নয়। বাড়তি শৌচাগারের ব্যবস্থা হতে পারে। ঝুপড়িতে বিকেল পাঁচটা থেকে সকাল ছ’টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ দিচ্ছি।’’ টালার খালধার এবং রেল আবাসনের পাশে ঝুপড়ি ছাড়াও ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে সেচ দফতরের জমিতে আপাতত পুনর্বাসনের আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি।

সেই আশ্বাসে ঝুপড়ির ঘরে বসে অবশ্য উৎকণ্ঠা ফিকে হচ্ছে না ক্যানসার রোগী মঞ্জু মণ্ডল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী শান্তনু মণ্ডলদের। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, প্রজেক্ট জমা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত কিশোর বলছে, ‘‘ঝড়ের রাতটায় প্লাস্টিকের ঘরে কী ভাবে যে বইগুলো বাঁচিয়েছি। গোটা পরিবার খাটে উঠে জেগে বসেছিলাম।’’ ঘরে জল ঢুকে গ্যাস সিলিন্ডারের দফারফা! শান্তনুর মা সুলেখা মণ্ডলের চিন্তা রান্না নিয়ে। ‘ঘরহারা’রা কেউ আর জি করে অ্যাম্বুল্যান্সের চালক, কেউ নিউ টাউনে আয়ার কাজ করেন। কেউ আবার স্থানীয় ছাতু বিক্রেতা। এ দিনও পুনর্বাসনের সুষ্ঠু ব্যবস্থার আশায় বরো চেয়ারম্যানের কাছে ধর্না দিয়েছেন তাঁরা। এই বাসিন্দাদের প্রতি কিছুটা সহৃদয়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় বস্তিবাসীদের অধিকার নিয়ে সরব সমাজকর্মী তথা নাগরিক সমাজের একাংশ। উত্তমের কথায়, ‘‘এত দিন পরে এখন জবরদখলকারী বলা তো সেই গাছে তুলে মই কেড়ে
নেওয়াই হল!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Tallah Bridge Kolkata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy