ধরা পড়লেও কয়েক ঘণ্টাতেই জামিন। এর পরে আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা থাকে ঠিকই, কিন্তু আইনজীবী বা নিদেনপক্ষে মুহুরি ধরা থাকলেই হল। হাজিরার ব্যাপারই থাকে না! অপরাধ মেনে নিয়ে মুহুরি মারফৎ জরিমানা মিটিয়ে দিলেই যে কে সেই!
মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়লেও তেমন কড়া শাস্তি না হওয়ার কারণেই কি লাগাম টানা যাচ্ছে না বেপরোয়া মনোভাবে? ঠাকুরপুকুরে ভরা বাজারে মত্ত অবস্থায় গাড়ি ছুটিয়ে এক জনকে পিষে মারার ঘটনায় চালকের সঙ্গেই গাড়িতে উপস্থিত মত্ত আরোহীদেরও কেন গ্রেফতার করা হবে না, সেই নিয়ে আলোচনা চলছে নানা মহলে। যদিও আইনজীবী থেকে পুলিশের একাংশের দাবি, যাত্রী মত্ত থাকলেও এমন ক্ষেত্রে আইনত তাঁদের গ্রেফতার করার বিধান নেই। প্রশ্ন উঠছে, মত্ত চালকের বিরুদ্ধেও কি কড়া পদক্ষেপের সংস্থান আছে? আইনজীবীদের অনেকেই বলছেন, এ ক্ষেত্রে শুধু জরিমানা বাড়ানো হয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে। কিন্তু ধরা পড়লেও মামলা সেই আগের মতো জামিনযোগ্য ধারাতেই করতে হয়। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে থানা থেকেই জামিনে বেরিয়ে আসতে পারেন মত্ত চালক। শুধু তা-ই নয়, যে ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী তাঁদের ধরলেন, বহু ক্ষেত্রেই জামিন পেয়ে সেই পুলিশকর্মীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপারটা থানা পর্যন্তও যায় না বলে দাবি পুলিশেরই। তার আগেই কোনও না কোনও প্রভাবশালীর ফোন চলে আসে। নির্দেশ দেওয়া হয়, বুঝিয়ে ছেড়ে দিয়ে কার্যোদ্ধার করার!
কোনও নাকা তল্লাশিতে ট্র্যাফিক পুলিশের তরফে ‘ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার’ পরীক্ষায় কেউ ধরা পড়লে তাঁকে থানার হাতে তুলে দেওয়া দস্তুর। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ৩০ মিলিগ্রাম মাদকজাতীয় দ্রব্যের উপস্থিতি মিললেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গাড়ি বা মোটরবাইক চালানোর যোগ্য নয় বলে ধরা হয়। এই অবস্থায় যান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। থানার হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে পুলিশ ‘ব্রেথ অ্যানালাইজ়ার’ যন্ত্রের রেটিংয়ের কাগজ জমা দেয়। থানা থেকে এর পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কোনও সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখার কথা। সেখানেও রক্তে মাত্রাতিরিক্ত মাদকজাতীয় দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা শুরু করতে পারে পুলিশ।
এমন ক্ষেত্রে ১৯৮৮ সালের মোটর ভেহিক্ল আইন অনুযায়ী, ১৮৪ (বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি বা মোটরবাইক চালানো) এবং ১৮৫ (মত্ত অবস্থায় গাড়ি বা মোটরবাইক চালানো) ধারায় পুলিশ মামলা করতে পারে। কিন্তু দুই ধারাই জামিনযোগ্য। থানার ওসি-র থেকে ধরা পড়ার রাতেই জামিন নিতে পারেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। শুধু পরের দিনই তিনি আদালতে হাজিরা দেবেন জানিয়ে পরিচিত কাউকে থানায় ব্যক্তিগত বন্ড জমা দিতে হয়। গাড়ি বা মোটরবাইকটি তিনি চালাবেন না, এই শর্তেই এর পরে বেরিয়ে যেতে পারেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। জানা যাচ্ছে, এমন ক্ষেত্রে থানার ওসি চাইলে জামিন না দিয়ে
আদালত থেকেই জামিন নেওয়ার কথা বলতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নানা কারণে ওসিরা সেই পথে হাঁটেন না। ভুক্তভোগীদের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে টাকার লেনদেনে বিষয়টি মিটমাট হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে থানা থেকেই আইনজীবী দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে বলে টাকায় রফা করিয়ে নেওয়া হয়।
কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের এক অফিসার বলছেন, ‘‘এই সমস্ত ক্ষেত্রে তিন মাসের জন্য লাইসেন্স সাসপেন্ড করার জন্য পুলিশের তরফে আরটিও-কে চিঠিও দেওয়া যায়। কিন্তু তেমন কিছুই আদতে করা হয় না। আইনজীবী ধরা থাকলে তো ভাল কথা, পরের দিন আদালতে হাজিরা না দিলেও চলে যায় মুহুরি ধরা থাকলেই।’’
কড়া শাস্তি না হওয়ার কারণেই কি তবে ঠাকুরপুকুরের মতো ঘটনা ঘটে যায়? ভুক্তভোগীদের দাবি, এ নিয়ে চর্চা চলতেই থাকে, বাস্তবে কিছুই বদলায় না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)