Advertisement
০১ জুলাই ২০২৪
Kanchanjunga Express Accident

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেও যাত্রীদের পিছু ছাড়ছে না আতঙ্ক

রাত তখন ৩টে ১৬। শিয়ালদহের ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এলেন যাত্রীরা। স্টেশনে পা দিয়েই কেঁদে ফেললেন রঞ্জিত পণ্ডিত। সেখানে উপস্থিত কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম তাঁকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকেন।

ফেরা: দুর্ঘটনার পরে সোমবার রাতে যাত্রীদের নিয়ে শিয়ালদহ পৌঁছল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে।

ফেরা: দুর্ঘটনার পরে সোমবার রাতে যাত্রীদের নিয়ে শিয়ালদহ পৌঁছল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

মিলন হালদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৪ ০৭:২৯
Share: Save:

আতঙ্কের যাত্রা তো শেষ হল। কিন্তু আতঙ্ক? তা কি পিছু ছাড়বে এত সহজে? সোমবার শেষ রাতে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পৌঁছনো দুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীদের সকলের চোখেমুখেই যেন সেই তীব্র আতঙ্কের ছাপ। সোমবার সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের কাছে রাঙাপানি এবং নিজবাড়ি স্টেশনের মাঝে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কলকাতামুখী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। সোমবারই গভীর রাতে শেষ হল সেই আতঙ্কের যাত্রা।

রাত তখন ৩টে ১৬। শিয়ালদহের ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এলেন যাত্রীরা। স্টেশনে পা দিয়েই কেঁদে ফেললেন রঞ্জিত পণ্ডিত। সেখানে উপস্থিত কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম তাঁকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। বলেন, ‘‘যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ভুলে যান। সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ আদতে কোচবিহারের বাসিন্দা, ৪৪ বছরের রঞ্জিত ভাড়া থাকেন বিরাটিতে। চাকরি করেন জিপিও-তে। দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ফের কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘‘চার দিকে কত মানুষ পড়ে রয়েছেন। এত মৃত্যু চোখে দেখা যায় না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘যা বলা হচ্ছে, ট্রেন দুর্ঘটনায় তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’’

দুর্ঘটনার সময়ে বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন ত্রিপুরার কৈলাশহরের যুবক সুমিত দেবরায়। শিয়ালদহে নেমে সেই বন্ধুকে দেখে সুমিতের মুখে হাসি। আর সুমিতকে দেখে বন্ধু সৌরভ ভট্টাচার্যের মুখে স্বস্তির ছাপ। আগরতলার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি-টেক পাশ সুমিত কলকাতায় এসেছেন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। কিন্তু আসার পথে যে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি বছর তেইশের ওই যুবক। আগরতলা থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন। সুমিত বলেন, ‘‘তখন সকাল সাড়ে ৮টা-পৌনে ৯টা হবে। ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পেরিয়েছে। আমি ছিলাম এ-ওয়ান কামরায়। ফোনে সৌরভের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আচমকা দু’-তিন বার ঝটকা। আমাদের কামরাটা পুরো কেঁপে উঠল। নেমে দেখি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে মালগাড়ি ধাক্কা মেরেছে। আমাদের কামরার পিছনের কামরাটি লাইনচ্যুত। সেটির পিছনের তিনটি কামরা একদম উল্টেপাল্টে গিয়েছে। জখম অনেক যাত্রী পড়ে ছিলেন। প্রচণ্ড ভয় করছিল। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।’’ সৌরভও আদতে কৈলাশহরের বাসিন্দা। কলকাতায় চাকরি করেন। থাকেন কেষ্টপুরে। সুমিত সেখানেই থাকবেন। সৌরভ বললেন, ‘‘দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ওকে দেখে শান্তি পেলাম।’’

শিলং-অরুণাচল প্রদেশ ঘুরে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে বাড়ি ফিরছিলেন বিরাটির বাসিন্দা, প্রাক্তন রেলকর্মী প্রতিমা দাস। তাঁকে নিতে শিয়ালদহে এসেছিলেন ছেলে শমীক দাস। শমীক বলেন, ‘‘মা আমাদের কিছুই জানাননি। টিভি দেখে দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। তার পরে মাকে ফোন করায় মা জানান, তিনি একদম ঠিক আছেন। তখন উদ্বেগ কাটে।’’
দুর্ঘটনাগ্রস্ত যাত্রীদের সুষ্ঠু ভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে রাতে স্টেশনে আসেন মেয়র ও পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী। ছিলেন পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র। যাত্রীদের জন্য পরিবহণ দফতর গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। স্টেশনে হাজির পরিবহণ সচিব সৌমিত্র মোহন জানান, ১৬টি বাস ও ৬০টি গাড়ির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাঁচটি অ্যাম্বুল্যান্সেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত যাত্রীরা সেই সব বাসে-গাড়িতে রওনা দেন গন্তব্যের উদ্দেশে। ফিরহাদ বলেন, ‘‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বর্তমানে কেন্দ্রে এমন একটি সরকার রয়েছে, যারা মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস চালু করেছিলেন। এত বছরেও কেন্দ্রীয় সরকার সর্বত্র তা লাগাতে পারল না। কেন্দ্রের উদাসীনতার জন্যই এত জনের প্রাণ গেল। যাত্রীদের এত ভোগান্তি হল।’’

রেলের বি আর সিংহ হাসপাতালের তরফে একটি মেডিক্যাল টিম স্টেশনে হাজির ছিল আহত যাত্রীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। তাদের কাছে কয়েক জন যাত্রী চিকিৎসা করিয়েছেন। কৌশিক মিত্র বলেন, ‘‘বি আর সিংহ হাসপাতালে ১০টি শয্যাও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, ট্রেনের সমস্ত যাত্রী খাবার, জল ঠিকঠাক মতো পেয়েছেন। অঞ্জু রায় নামে এক মহিলা যাত্রী বলেন, ‘‘ট্রেনে খাবার, জল পেয়েছি। বাড়ি ফিরছি। এখন কিছুটা স্বস্তি।’’ ট্রেন থেকে নেমে অসুস্থ বোধ করায় স্টেশন চত্বরের মেডিক্যাল টিমের কাছে আসেন গোপাল দেবনাথ নামে এক যাত্রী। সেখানে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন চিকিৎসকেরা। দেওয়া হয় ওআরএস। গোপালের বাড়ি হাওড়ায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE