দায়িত্ব: শিশুর দেখাশোনার ভার নিয়েছে একরত্তিই। শুক্রবার হেস্টিংস এলাকায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
রাতে ঘুমোতে যাবেন লক্ষ্মী হালদার। কিন্তু তাঁর ঘুমোতে যাওয়া আর পাঁচ জন মায়ের মতো নয়। হেদুয়ায় তাঁর ফুটপাতের সংসারে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বেশ কিছু ক্ষণ ধরে প্রস্তুতি চলে। নিজের কোমরের সঙ্গে দেড় বছরের ছেলেকে দড়ি অথবা চাদর দিয়ে বেঁধে নিয়ে শুতে হয় তাঁকে। কেন এমন করেন? লক্ষ্মী বলেন, ‘‘ফুটপাতে থাকি। ফুটপাতেই ঘুমোই। ঘুমন্ত অবস্থায় ছেলেকে কেউ যদি চুরি করে পালায়? কত রকম ঘটনার কথাই তো শুনতে পাই। ছেলে জন্মানোর পর থেকে এ ভাবেই ওর সঙ্গে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘুমোই।’’
কোমরে দড়ি বাঁধেন না, তবে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের দু’নম্বর গেটের কাছে ফুটপাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাথার পাশে একটি লাঠি অথবা আধলা ইট রেখে দেন রশিদা দাস। রশিদার মেয়ের বয়স বছর চারেক। মেয়েকে বুকের কাছে শুইয়ে তাকে জাপ্টে ধরে ঘুমোন তিনি। রশিদা বলেন, ‘‘আমি আসলে জেগে ঘুমোই। রাতে কেউ যদি অসভ্যতা করার চেষ্টা করে, তা হলে সে পার পাবে না। হাতের কাছে লাঠি থাকে। আধলা ইট আছে। নিজেকে বাঁচতে হবে, নিজের মেয়েকেও বাঁচাতে হবে। মদ খেয়ে অসভ্যতা করতে আসা এমন কত লোককে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’’
উত্তরের শ্যামবাজার থেকে দক্ষিণের গড়িয়াহাট— ফুটপাতবাসী বেশির ভাগ মা-ই বলছেন, বাধ্য হয়েই তাঁরা জেগে ঘুমোনোর অভ্যাস করে নিয়েছেন। সেই ঘুম এমনই যে, খুব কাছ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও ভেঙে যায়। রুমা দাস নামে এক মহিলা বললেন, ‘‘ফুটপাতে আমাদের ঘুম এতই পাতলা যে, মনে হয়, কারও ছায়া আমাদের উপর দিয়ে চলে গেলেও জেগে যাব। ছেলে-মেয়ে নিয়ে রাতে নিশ্চিন্ত ঘুম আমাদের ভাগ্যে নেই।’’ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের মোড়ের কাছে ফুটপাতে থাকেন আঙুরি নায়েক। তাঁর চার মেয়ে। ডান হাতের তর্জনী তুলে ফুটপাতের একটি দোকান দেখিয়ে আঙুরি বলেন, ‘‘ওই দোকানে দুটো সিসি ক্যামেরা আছে। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হয় না। আমরা যেখানে শুই, সেই জায়গাটা অন্ধকার। কেউ কু-মতলব নিয়ে কিছু করতে এলে তাকে তো সিসিটিভি-তে দেখাই যাবে না। তাই খুব ভয়ে থাকি। আমার চার মেয়ে। মশারির উপরে কাপড় মেলে ঘুমোই। কিন্তু নিশ্চিন্তে ঘুম কি আর হয়?’’
কখনও কিছু ঘটে গেলে পুলিশে অভিযোগ করেন? ভোলা সর্দার নামে ফুটপাতবাসী এক যুবক বললেন, ‘‘পুলিশ টহল দেয় না বললে মিথ্যা বলা হবে। বিপদে পড়ে ডাকলে পুলিশ আসেও। কিন্তু লিখিত অভিযোগ সব সময়ে নিতে চায় না। তাই
পুলিশে অভিযোগ করে কী লাভ?’’ যদিও কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-নগরপাল (সদর) মিরাজ খালিদ বললেন, ‘‘এখন বেশির ভাগ রাস্তার ফুটপাতেই সিসি ক্যামেরা রয়েছে। আরও বেশি করে ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা আছে। পুলিশি টহল নিয়মিত চলে। অভিযোগ পেলেই খতিয়ে দেখা হয়।’’
সম্প্রতি বড়তলা থানা এলাকায় সাত মাসের একটি শিশুকে ফুটপাত থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে এক যুবকের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনার কথা ফুটপাতবাসী মায়েরা প্রায় সকলেই জানেন। গিরিশ পার্ক এলাকার এমনই এক ফুটপাতবাসী পিঙ্কি প্রামাণিকের কথায়, ‘‘ঘটনাটা কী মারাত্মক, ভাবলেই আমাদের গা হিম হয়ে আসছে। আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও তো ফুটপাতে থাকে। গত ২০ বছর ধরে এই ফুটপাতেই সংসার করছি। নানা ঘটনার কথা শুনি। এখানেই বা তেমন কিছু ঘটতে কত ক্ষণ? তাই আমরা ছোট থেকেই কিছু নিয়ম শিখিয়ে রেখেছি আমাদের ছেলেমেয়েদের। বলেছি, সেই নিয়মগুলো মানলে বিপদের আশঙ্কা কমবে।’’
কী কী নিয়ম শেখানো হয়েছে?
পিঙ্কি বললেন, ‘‘ছেলেমেয়েরা একটু বড় হলেই বলে দিই, বেশি রাতে ফুটপাতে কেউ অযথা ঘোরাঘুরি করলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যেতে হবে। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লেও তাঁদের ডেকে তুলতে হবে। দ্বিতীয় নিয়ম হল, একটি স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠনের হেল্পলাইন নম্বর সকলকে মুখস্থ রাখতে হবে। ওই সংগঠন এখানকার বাচ্চাদের পড়ায়। ওদের নম্বর সকলের মুখস্থ। বিপদে পড়লে যে কারও ফোন থেকে ওই নম্বরে
ফোন করতে পারবে ওরা। তৃতীয়ত, চেনা বা অচেনা যে কেউ অকারণে ডাকলে বা খাবারের লোভ দেখিয়ে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে যাবে না। কিন্তু তাতেও আতঙ্ক কাটে না। রাতে ওদের চোখের আড়াল হতে দিই না।’’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy