Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
Firecrackers

‘অপরাধীদের কিছু হল না, সাজা হল শুধু আমাদের’

মোচপোল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে নারায়ণপুরে গেলেও নজরে আসবে অবৈধ বাজি ব্যবসার রমরমা। রাস্তার পাশেই ‘বৈধ’ বাজির পসরা দিয়ে সাজানো দোকান। কিন্তু ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেই মুহূর্তের মধ্যে ‘স্যাম্পল’ চলে আসছে সামনে।

দত্তপুকুর নীলগঞ্জ মোচপোলে বাজী বিস্ফোরণের এক বছর পরেও পরে আছে ধ্বংসস্তুপ।

দত্তপুকুর নীলগঞ্জ মোচপোলে বাজী বিস্ফোরণের এক বছর পরেও পরে আছে ধ্বংসস্তুপ। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

চন্দন বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:০১
Share: Save:

‘‘হাতির খাওয়ার দাঁত আর দেখানোর দাঁত কি এক হয়? দোকানে যা দেখছেন, সবই দেখানোর জন্য। আসল জিনিস বাড়ির ভিতরে রয়েছে। আপনি যা চাইবেন, যত চাইবেন, পেয়ে যাবেন। লুকিয়ে-চুরিয়ে একটা-দুটো ‘স্যাম্পল’ দেখে নিন। পছন্দ হলে বস্তা বস্তা মাল গাড়িতে তুলে দেব।’’ বছরখানেক আগে দত্তপুকুরের মোচপোলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিস্ফোরণের ‘ক্ষত’ এখনও শুকোয়নি। ঘটনাস্থলের আশপাশের বাড়িগুলিকে সারিয়ে, রং করে নতুন চেহারা দেওয়া হলেও বিস্ফোরণস্থলের ভয়াবহতা এখনও স্পষ্ট। বাড়ির ভাঙা দেওয়াল থেকে শুরু করে মাটিতে পড়ে যাওয়া ছাদের অংশ সারানো হয়েছে শুধু। ওই ঘটনার পরেও এলাকায় বেআইনি বাজির কারবারের রমরমা কমেনি এতটুকু।

মোচপোল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে নারায়ণপুরে গেলেও নজরে আসবে অবৈধ বাজি ব্যবসার রমরমা। রাস্তার পাশেই ‘বৈধ’ বাজির পসরা দিয়ে সাজানো দোকান। কিন্তু ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেই মুহূর্তের মধ্যে ‘স্যাম্পল’ চলে আসছে সামনে। কালীপুজোর আগে ওই এলাকায় অচেনা গাড়ি ঢুকতে দেখলেই আশপাশ থেকে চাপা গলায় প্রশ্ন আসছে, ‘‘কী লাগবে?’’ কাউকে আবার বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘সব আগের মতো। যা চাইবেন, তা-ই পাবেন।’’

নারায়ণপুরে গেলে নজরে আসবে অবৈধ বাজি ব্যবসার রমরমা।

নারায়ণপুরে গেলে নজরে আসবে অবৈধ বাজি ব্যবসার রমরমা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

গত শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য পুলিশকে এ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। আতশবাজির আড়ালে ‘দুষ্টু লোকেরা’ যাতে নিষিদ্ধ বাজির কারবার না চালায়, তা দেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, বাস্তব পরিস্থিতি তা-ই বলছে। সম্প্রতি এক দিন মোচপোল ঘুরে যখন নারায়ণপুরে যাওয়া হল, তখন দুপুর পেরিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই পথের দু’ধারে সারি সারি দোকান। কেউ সবে পসরা সাজাচ্ছেন, কেউ দোকান সাজিয়ে রাস্তায় খদ্দের ধরতে ব্যস্ত। বসত বাড়ির ভিতরেও চলছে বাজির ব্যবসা।

রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই কয়েক জনের ঘেরাটোপে কার্যত থামতে হল। হাত ধরে টেনে দোকানে বসালেন তাঁদেরই এক জন। নিজেকে নাজিবুল হোসেন বলে পরিচয় দিয়ে এক যুবক বললেন, ‘‘বাজি তো? আপনাদের যা লাগবে, সব হয়ে যাবে। এমন আওয়াজ হবে, পাশের পাড়ার লোকজন কাঁপবে। পুলিশের চক্করে দোকানের সামনে কেউ কিছু রাখছি না।’’ কথা শেষ না করেই একের পর এক চকলেট থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ শব্দবাজির ‘স্যাম্পল’ এনে দেখাতে শুরু করলেন তিনি। নিজেরাই সে সব বানিয়েছেন বলে দাবি করলেন। একই ছবি পাশের দোকানেও। বেশি করে কিনলে ফেরার পথে পুলিশি ঝঞ্ঝাট ‘দেখে নেওয়ার’ প্রতিশ্রুতিও দিলেন কেউ কেউ।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত বছর অগস্টে মোচপোলে বিস্ফোরণ এবং ন’জনের মৃত্যুর ঘটনার পরে কয়েক মাস এলাকায় বেআইনি বাজির কারবার বন্ধ ছিল। কারণ, বাজির কারবারের ‘মাথা’রা অনেকেই এলাকাছাড়া ছিলেন। যদিও কয়েক মাস পরে তাঁদের অধিকাংশই এলাকায় ফিরেছেন। মোচপোলের বাসিন্দাদের চাপে নতুন করে সেখানে আর এই কারবার শুরু না হলেও পাশেই নারায়ণপুরে শাখা-প্রশাখা বেড়েছে। মোচপোল-কাণ্ডের মাথাদের অনেকেই সেখানে গিয়ে ভিড়েছেন। বেআইনি বাজির বিষবৃক্ষ মোচপোলে বেড়ে উঠতে না পারলেও নারায়ণপুরে ডালপালা মেলে আরও একটি বিস্ফোরণের অপেক্ষা করছে।

মোচপোলের বিস্ফোরণে কোনও মতে বেঁচে গিয়েছিলেন আসুরা বিবি। তাঁর দোতলা বাড়ির একাংশ বিস্ফোরণে কার্যত উড়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আসুরা। বারকয়েক অস্ত্রোপচারের পরেও শ্রবণশক্তি এখনও পুরোপুরি ফিরে পাননি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘‘অপরাধীদের কিছু হল না, সাজা হল শুধু আমাদের। পুলিশ কিছু দিন দৌড়োদৌড়ি করল। তার পরে সব চুপ।’’

বারাসত পুলিশ জেলার কর্তারা যদিও চুপ থাকার কথা অস্বীকার করছেন। এক কর্তার কথায়, ‘‘বেআইনি বাজির কারবার রুখতে বিশেষ দল রয়েছে। ওই এলাকায় প্রতিদিন পুলিশের সেই দল টহল দেয়। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বেআইনি বাজির কারবার যাতে কোনও ভাবে না চলে, সে দিকে আমাদের নজর রয়েছে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy