ফাইল চিত্র।
ব্যক্তি এক জনই। অথচ, তাঁর ময়না-তদন্তের দু’টি রিপোর্ট দু’রকম। প্রথমটিতে মৃত্যুর কারণ ‘স্বাভাবিক’ লেখা হয়েছে। দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, মাথায় আঘাতের কারণে মৃত্যু।
নিয়ম অনুযায়ী, স্বাভাবিক মৃত্যুর রিপোর্ট জমা দিলে শ্রম দফতর থেকে ওই ব্যক্তির পরিজনেদের পাওয়ার কথা ৫০ হাজার টাকা। আর দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর রিপোর্ট জমা দিলে মিলবে দু’লক্ষ টাকা। প্রথমটি জমা করে টাকা পাওয়ার পরে, পরিজনেরা দ্বিতীয়টি জমা করে বাকি টাকা পাওয়ার আবেদন করেছেন। যা দেখে চমকে উঠছেন মুর্শিদাবাদের শ্রম দফতরের আধিকারিকেরা। প্রশ্ন উঠেছে, খোদ নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তরফে কয়েক মাসের ব্যবধানে এমন বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট দেওয়া হল কী করে? মাথায় আঘাতের কারণে যে রোগীর মৃত্যু হল, তাঁর ময়না-তদন্তে স্বাভাবিক কারণ লেখা হয় কী ভাবে?
নীলাদ্রি মণ্ডল নামে ময়না-তদন্তকারী যে চিকিৎসক দু’টি রিপোর্টেই সই করেছিলেন, তাঁর দাবি, ‘‘কম্পিউটারে একটি রিপোর্টের ফরম্যাট কপি করে আর একটিতে পেস্ট করার পরে সেটির উপরেই নতুন রিপোর্ট লেখা হয়। তেমন করার সময়ে কোনও ভাবে নতুনটা সেভ হয়নি। পরে পুলিশ আমাকে জানাতে, আসল নথি দেখে রিপোর্ট ঠিক করে দিই।’’ ময়না-তদন্তের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, কম্পিউটারে এমন পদ্ধতিতে রিপোর্ট তৈরি করা হলেও, দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে দেওয়া মারাত্মক ভুল। আর তেমন যদি হয়েও থাকে, তা হলে দ্বিতীয় রিপোর্টে সংশোধন কথাটা লেখা উচিত ছিল। প্রথম রিপোর্টটিও জমা নিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু, কোনওটাই করা হয়নি।
২০২০ সালে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা, পেশায় নির্মাণকর্মী জগন্নাথ কোনাই (৫৯)। তাঁকে প্রথমে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পরে এন আর এসে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঁচ দিন পরে তিনি মারা যান। মাথায় আঘাত নিয়ে ভর্তির কারণে এন্টালি থানা অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে দেহটি ময়না-তদন্তে পাঠায়। তার রিপোর্টে (পিএম নম্বর-২৯৩) জানানো হয়, মৃতের শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক।
প্রৌঢ়ের মেয়ে সুনীতা কোনাই বলেন, ‘‘বেশি লেখাপড়া জানি না। তাই ওই রিপোর্ট নিয়ে চলে আসি। সে বছর কোভিডের কারণে শ্রম দফতরে আবেদন করে উঠতে পারিনি।’’ ২০২১-এর ৯ অগস্ট ওই রিপোর্ট-সহ মুর্শিদাবাদের শ্রম দফতরে ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন সুনীতারা। তাঁর দাবি, ‘‘ডিসেম্বর মাসে জানতে পারি, ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাবা তো দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন, তাই ২ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা। বিষয়টি জানতে শ্রম দফতরে গেলে বলা হয়, ময়না-তদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ স্বাভাবিক লেখা রয়েছে।’’ সুনীতার আরও দাবি, ‘‘হাসপাতালে গিয়ে বলি রিপোর্ট ঠিক করে দেওয়ার জন্য।’’ এরই মধ্যে ২২ ডিসেম্বর তাঁরা রাজ্যের তরফে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়ে যান।
২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ফের এন আর এস থেকে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট দেওয়া হয়। সেখানে পিএম নম্বর থেকে শুরু করে তারিখ, চিকিৎসকের সই-সহ সব এক থাকলেও আঘাতের চিহ্নের জায়গায় ছ’টি বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়, জগন্নাথবাবুর মৃত্যুর কারণ মাথায় আঘাত। তবে সেই রিপোর্টটি সংশোধিত, এমন কিছু উল্লেখ ছিল না। ফেব্রুয়ারিতেই ওই দ্বিতীয় রিপোর্ট-সহ ক্ষতিপূরণের বাকি দেড় লক্ষ টাকা পেতে আবেদন করেন সুনীতারা। মুর্শিদাবাদের যুগ্ম শ্রম কমিশনার (পার্সোনেল) বিতান দে বলেন, ‘‘একই ব্যক্তির দু’টি দু’ধরনের ময়না-তদন্তের রিপোর্ট জমা পড়েছিল। কোনটি ঠিক, তা হাসপাতালের কাছে জানতে চাওয়া হয়।’’
কিন্তু উত্তর না-পেয়ে চলতি বছরের এপ্রিলে আবারও এন আর এসে চিঠি পাঠানো হয়। ১৯ এপ্রিল এন আর এসের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক সৌরভ চট্টোপাধ্যায় জানান, দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যুর রিপোর্টটি ঠিক। তা হলে কী ভাবে প্রথমে এমন ভুল হল? সৌরভবাবু বলেন, ‘‘২০২০ সালে আমি এন আর এসে ছিলাম না। তাই বিশেষ কিছু জানি না। কলকাতা পুলিশের পোর্টালে যে রিপোর্টটি আপলোড করা হয়েছে, সেটির সঙ্গে মিলিয়েই এটি ঠিক বলে জানিয়েছি।’’
অনেকেই বলছেন, ‘‘সরকারি কাগজের ভুল সংশোধন করতে যেখানে প্রায়ই হয়রানির অভিযোগ ওঠে, সেখানে এত সহজে দ্বিতীয় রিপোর্ট মিলল কী ভাবে?’’ যদিও সুনীতার দাবি, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই সব কিছু পেয়েছেন। হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, সাংসদ শান্তনু সেনের কথায়, ‘‘ওই সময়ে আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না। বিষয়টি নজরে এসেছে। অবশ্যই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে খতিয়ে দেখা হবে।’’
তবে এখনও ক্ষতিপূরণের বাকি টাকা পাননি সুনীতারা। জেলা শ্রম দফতর জানাচ্ছে, দ্বিতীয় রিপোর্টের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy