Advertisement
E-Paper

অবৈধ বহুতলই শুধু নয়, মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে বহু জীর্ণ বাড়িও

শহর জুড়ে অবাধেই চলে অবৈধ নির্মাণ। পুলিশ বা প্রশাসন সব জেনেও ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু কেন? উত্তরের খোঁজে আনন্দবাজার।

—প্রতীকী চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৪৫
Share
Save

বছর দুয়েক আগে বিপজ্জনক বাড়ির নোটিস পড়েছিল। নোটিস পেয়ে তেতলা বাড়িটির মালিক ছয় ভাড়াটেকে সংস্কারের কাজের জন্য ঘর খালি করতে বলেন। কিন্তু খালি করা তো দূর, উচ্ছেদের আশঙ্কায় ভাড়াটেরা মামলা ঠুকে দেন আদালতে। ঝামেলা এড়াতে বাড়ির মালিকও আর সংস্কারের কাজে এগোননি। সেই ঘটনার পরে পেরিয়েছে কয়েক বছর। বিপদ মাথায় নিয়ে এখনও রবীন্দ্র সরণির ওই বাড়িতে বসবাস করছেন ভাড়াটেরা। কোথাও ভাড়াটের সঙ্গে বাড়ির মালিকের দ্বন্দ্ব, কোথাও বাড়ি ঘিরে শরিকি বিবাদ, কোথাও আবার মালিকেরই বেপাত্তা হয়ে যাওয়া— এ সব গেরোতেই বিপজ্জনক বাড়িগুলি থেকে যায় বছরের পর বছর।

দিনকয়েক আগেই গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়েছিল নির্মীয়মাণ বেআইনি বহুতল। তাতে প্রাণ হারান ১৩ জন। ওই ঘটনার পরে বিরাটিতেও একটি নির্মীয়মাণ বহুতলের একাংশ ভেঙে পড়ে মৃত্যু হয় এক মহিলার। শুধু নির্মীয়মাণ বাড়ি নয়, গত কয়েক সপ্তাহে চেতলা, বৌবাজার, ঠাকুরপুকুর-সহ শহরের একাধিক জায়গায় জীর্ণ বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ভেঙে পড়া বাড়ির সামনে ‘বিপজ্জনক’ লেখা কোনও নোটিসও ঝোলানো ছিল না।

কলকাতা পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরে নথিভুক্ত বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে ৫০০-রও কিছু বেশি বাড়ি অত্যন্ত বিপজ্জনক। যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু বিপদ বুঝেও পুরসভার তরফে কার্যত নোটিস ঝুলিয়েই দায় সারা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই বাড়ি ভাঙার বা সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। পুরসভার যুক্তি, বিপজ্জনক বাড়িতে থাকা ভাড়াটে বা জবরদখলকারীরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সব কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ান। দীর্ঘদিন ধরে নামমাত্র ভাড়ায় থাকা ভাড়াটেরা কিছুতেই বিপজ্জনক বাড়ি থেকে সরতে চান না। তাঁদের আশঙ্কা, এক বার সরে গেলে আর ফিরতে পারবেন না। এই সমস্যা কাটাতে পুরসভার তরফে ভাড়াটেদের ‘অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেট’ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু তার পরেও শহরের বিপজ্জনক বাড়িগুলি খালি করে ভাঙার বা সংস্কারের কাজ গতি পায়নি।

বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কারে পুর আইন রয়েছে। সেই অনুযায়ী, পুরসভা প্রথমে ওই বাড়িতে বিপজ্জনক নোটিস ঝোলাবে। তাতেও ভাড়াটেরা না সরলে ‘অতি বিপজ্জনক’ লেখা নোটিস ঝোলানো হবে। খাতায়-কলমে আইন থাকলেও বছরের পর বছর বিপজ্জনক বাড়িগুলি দাঁড়িয়ে আছে বিপদ মাথায় নিয়ে। দায় এড়াতে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের এক কর্তার সাফাই, ‘‘কোনও বাড়িতে বিপজ্জনক নোটিস ঝোলানোর পরে ভাড়াটেদের বাড়ি ফাঁকা করার নোটিস দেওয়া হয়। বাড়ির মালিককে সংস্কারের কথা জানানো হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাড়াটেরা আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালতের হস্তক্ষেপে বাড়ি ভাঙার কাজ আর হয়ে ওঠে না। অনেক ক্ষেত্রে আবার মালিকের অনীহায় বাড়ির সংস্কার গতি পায় না।’’ যদিও পাল্টা পুরসভাকেই দুষছেন বাড়ির মালিকদের একাংশ। ‘ক্যালকাটা হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক সুকুমার রক্ষিত বলেন, ‘‘আমরা বিপজ্জনক বাড়ির সমস্যা সমাধানে পুরসভাকে বার বার অনুরোধ করেছি। ভাড়াটে-সমস্যা সমাধানেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পুরসভার সদিচ্ছা আছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।’’

শুধু বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙাই নয়, শহর ঘুরে সেগুলি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও বার বার গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে পুরসভার বিরুদ্ধে। দিনকয়েক আগে খোদ মেয়রের ওয়ার্ডেই ভেঙে পড়েছিল তেতলা বাড়ির বারান্দার অংশ। বিপজ্জনক বাড়ির নোটিস সেখানে ছিল না বলেই স্থানীয়দের দাবি। তা হলে বাড়িটি ভাঙল কেন? কেনই বা সেটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা হল না? এমন হাজারো প্রশ্ন পুরসভার ঢিলেমির দিকেই আঙুল তুলে দিচ্ছে।

গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের পরে গত কয়েক সপ্তাহে বিধাননগর ও দমদম পুর এলাকাতেও এ বিষয়ে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিধাননগর ও রাজারহাট এলাকায় এমন অনেক বহুতল তৈরি হয়েছে, যেগুলির কোনও তথ্যই নেই পুরসভার কাছে। ওই সমস্ত বহুতলের পুরসভা অনুমোদিত কোনও নকশাও নেই। বহুতলগুলি নিরাপদ কি না, পরীক্ষা করা হয়নি তা-ও। গত কয়েক বছর ধরে ওই সমস্ত এলাকায় বেআইনি নির্মাণ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে পুরসভা। ন’মাস আগে একটি কমিটি তৈরি করে বেশ কিছু নির্মাণ বন্ধ করেছেন পুর কর্তৃপক্ষ। কয়েকটি এফআইআর-ও হয়েছে। তবে, বাড়ির পরিকাঠামো কতটা বাসযোগ্য, তা পরীক্ষা করা যায়নি। যেমন করা যায়নি নির্মাণ সামগ্রীর গুণমান পরীক্ষাও। পুরসভার সাফাই, লোকাভাবে সর্বত্র নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না। যদিও পুর আইন অনুযায়ী, একটি নির্মাণের সবটা পরীক্ষা করার নির্দিষ্ট আধিকারিক ও ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন। তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি পাল্টায় না।

ফলে, শহরে বিপজ্জনক তকমা পাওয়া বহু পুরনো বাড়ির সঙ্গেই বিপদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বেআইনি বহুতলও। এ সব বাড়িতে ভবিষ্যতে আরও কত প্রাণহানি অপেক্ষা করছে, প্রশ্ন সেটাই। (শেষ)

তথ্য সংগ্রহ: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, নীলোৎপল বিশ্বাস, কাজল গুপ্ত, চন্দন বিশ্বাস, মেহবুব কাদের চৌধুরী

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Constructions Kolkata Safety Negligence Old house

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}