শুশ্রূষা: রাস্তাতেই চলছে চিকিৎসা। নিজস্ব চিত্র
চার দফায় কুকুরের ডায়ালিসিস হবে। তবে অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হবে না। পশু হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, অজ্ঞান করে ডায়ালিসিস করলে জ্ঞান আর না-ও ফিরতে পারে! জ্ঞান থাকা অবস্থাতেই গলার নীচের অংশ কেটে ভিতরে পাইপ ঢোকানো হবে। পাইপ থাকবে শেষ দফার ডায়ালিসিস পর্যন্ত। এ-ও জানানো হয়েছে, হাসপাতালে লোক নেই। তাই পাইপ ঢোকানোর সময়ে কুকুরের চারটে পা শক্ত করে ধরে থাকতে হবে পোষ্যের বাড়ির লোককেই! আর সবটাই হবে পশু হাসপাতালের সামান্য একটি টেবিলে শুইয়ে।
কারণ, কলকাতা শহরের সরকারি প্রতিষ্ঠান বেলগাছিয়া পশু হাসপাতালে কোনও ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট-ই (আইসিইউ) নেই! ওই অবস্থাতেই দিনের পর দিন চলছে পশুদের জটিল সব অস্ত্রোপচার। অথচ, সেখানে পশুদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা করানোর কোনও পরিকাঠামোও নেই। পশু চিকিৎসকেরাই বলেন, ‘‘নামেই হাসপাতাল। আসলে ওখানে কাজ হয় ক্লিনিকের মতো! ২৪ ঘণ্টা পরিষেবাও পাওয়া যায় না!’’ তাঁদের দাবি, শুধু ওই হাসপাতাল নয়, গোটা রাজ্যের কোথাও পশুদের ভর্তি রেখে চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই। ফলে স্যালাইন চলা, কেমো চলা পথ-কুকুরদের পড়ে থাকতে হয় রাস্তাতেই।
এ শহরের কোথাওই মেলে না পশুদের সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা ইকো কার্ডিয়োগ্রামের মতো পরিষেবা। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ে পাওয়া গেলেও জরুরি সময়ে পর্যাপ্ত রক্ত সংবহণের পরিষেবাও পাওয়া যায় না কলকাতায়! আর এর সুযোগ নিয়েই শহর জুড়ে বেআইনি পরীক্ষাগারের রমরমা চলছে বলে অভিযোগ। চিকিৎসকদের লাভের ভাগ দেওয়া সেই সমস্ত পরীক্ষাগার অনায়াসেই ভুয়ো রিপোর্ট বানিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ। কোথাও সুস্থ পশুর রিপোর্টে দেখানো হচ্ছে, সে গুরুতর অসুস্থ। কোথাও একই পশুর একই পরীক্ষার ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট আসছে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে! সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা এক ব্যক্তির আবার দাবি, ‘‘কিডনির গোলমাল দেখে নিজের পরিচিত পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছিলেন এক চিকিৎসক। সেখান থেকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে, তাতে জানানো হয়েছে, আমার পোষ্যটির নাকি কিডনিই নেই!’’
পশু চিকিৎসক অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘পরিকাঠামোশূন্য একটা পরিবেশ থেকে যাওয়ায় যে কেউ পরীক্ষাগারের নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসছেন। কয়েকটি জায়গা ভাল করলেও মাঝেমধ্যে তাদেরও নানা গাফিলতি পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি স্তর থেকে যত দিন না এ বিষয়ে নজর দেওয়া হচ্ছে, উন্নতির আশা নেই!’’ আর এক পশু চিকিৎসক কৌস্তুভ বসুর বক্তব্য, ‘‘জাতীয় পর্যায়ের ছাড়পত্র নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষাগারে খুলতে হয়। ক’টা পরীক্ষাগারের এই ছাড়পত্র রয়েছে, তা নিয়ে কেউ ভাবিত নন। মানুষের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারের নাম-সার্টিফিকেট দেখে যোগাযোগ করতে দেখেছি। পশুর ক্ষেত্রে সেই সার্টিফিকেট দেখতে চাওয়ার কথাই ভুলে যান পোষ্যের অভিভাবকেরা।’’
আর এক পশু চিকিৎসক বললেন, ‘‘বেলগাছিয়ার প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে পড়াশোনার মাঝে চিকিৎসকেরা পশুর চিকিৎসা করে দেন। সেটা কোনও পরিকাঠামোর নিদর্শন হতে পারে? এক্স-রে করানোরও কোনও জায়গা নেই। একটি ভাঙাচোরা বাড়িতে কোনও মানুষ এক্স-রে করাতে যান না বলে সেখানে পশুদের কিছু এক্স-রে হয়, এমনটাই শুনেছি।’’
পশ্চিমবঙ্গ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সভাপতি জহরলাল চক্রবর্তী যদিও বললেন, ‘‘বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির অবকাশ থাকলেও পরিকাঠামোর দিক থেকে কলকাতা আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল জায়গায় রয়েছে।’’ যদিও কাউন্সিলেরই এক সদস্যের বক্তব্য, শহরের পশুপ্রেমীদের পরিষেবা দেওয়ার চেয়েও সরকারি স্তর থেকে গ্রামে পশু চিকিৎসার প্রসার ঘটানোর দিকে বরাবরই বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই পশু-নির্ভর। ফলে সেখানে কাজ করলে যে জনসমর্থন সরকারে থাকা রাজনৈতিক দল পেতে পারে, শহরের তিন বা চার জনের সংসারের পোষ্যের জন্য করে তা মেলে না।
সেই কারণেই কি কলকাতা পরিকাঠামোর দিক থেকে এত পিছিয়ে? রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথকে বার বার ফোন করেও এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। তিনি টেক্সট মেসেজেরও উত্তর দেননি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy