চলছে পোস্টার তৈরির কাজ। শনিবার যাদবপুরে।—নিজস্ব চিত্র।
লক্ষ্য ছিল নারী-স্বাধীনতা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। লিঙ্গ-বৈষম্য, শ্লীলতাহানি-ধর্ষণের প্রতিবাদ ও ঋতুস্রাব নিয়ে অযথা গোপনীয়তার বিরোধিতা। উদ্দেশ্যকে স্বাগত জানাচ্ছেন অনেকেই, কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে পদ্ধতি নিয়ে। কারণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পড়ুয়া তাঁদের স্লোগানগুলি লিখেছেন স্যানিটারি ন্যাপকিনে। তাতে ছবিও আঁকা হয়েছে। তার পর সেগুলি সেঁটে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পাস জুড়ে। সহজে নজর কাড়তে চমকের বুদ্বুদ তৈরি, নাকি চিরস্থায়ী পরিবর্তনের বীজ বোনা ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যটা ঠিক কী, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সমাজের বিশিষ্টরা।
নারী জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত এমন একটি উপকরণকে অস্ত্র করে প্রতিবাদের কথা সাম্প্রতিক কালে প্রথম প্রচারে আসে গত ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অনেকটা একই উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতিতে নিজের দেশে আন্দোলন শুরু করেছিলেন জার্মান শিল্পী ইলোন কাস্ত্রাশিয়া। কিছু দিন পর একই পথে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাকয়েক পড়ুয়া। প্রতিবাদের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে জড়িতদের শো-কজ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সেই তালিকায় এ বার জুড়ল ‘হোক কলরব’-খ্যাত যাদবপুর। শুক্র ও শনিবার ক্যাম্পাস জুড়ে এই স্লোগান লেখা ও ছবি আঁকা স্যানিটারি ন্যাপকিন সেঁটেছেন একদল ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড, গাছপালা থেকে কংক্রিটের থাম বাদ যায়নি কিছুই। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত অনেকের মতে, প্রতিবাদের এই পদ্ধতি তো বটেই, ছবি ও স্লোগনের অনেকগুলিও যথেষ্ট আপত্তিকর।
যাদবপুরের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আশিসস্বরূপ বর্মা শনিবার বলেন, “প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু এই পদ্ধতিটা সমাজের রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে খাপ খায় না। তা ছাড়া, স্লোগানের ভাষাও কিছু ক্ষেত্রে অসংসদীয়।” জামিয়া মিলিয়ার মতো কোনও কড়া পদক্ষেপ করা হবে কি না, তা নিয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি। তবে কে বা কারা এই কাজ করেছে, তা জানার চেষ্টা চলছে বলে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য জানিয়েছেন।
প্রাক্তন ছাত্রনেতা তথা বর্তমান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে লেখিকা বাণী বসু, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার, অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রতিবাদের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে অনেকে প্রতিবাদীদের আক্রমণের পথে হাঁটেননি। যেমন, শিক্ষিকা শাশ্বতী ঘোষ, নাট্যকর্মী-সাংসদ অর্পিতা ঘোষ, অভিনেত্রী পাওলি দাম, সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘অভিনব’ প্রতিবাদের নেপথ্যে যাঁরা আছেন, সেই পড়ুয়ারা অবশ্য খোলাখুলি বলছেন, ভবিষ্যতে তাঁরা এ নিয়ে আরও বড় আন্দোলনের পথে যাবেন। তাঁদেরই এক জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অরুমিতা মিত্র শনিবার জানান, তাঁরা কয়েক জন পড়ুয়া মিলে ‘পিরিয়ডস’ নামে একটি ফোরাম তৈরি করেছেন। সেই ফোরামের পক্ষ থেকেই এই কাজ করা হয়েছে। অরুমিতার কথায়, “এক দিকে ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠলেই অভিযোগকারীর উপরে দোষারোপ করা হচ্ছে, তার উপরে ক্রমশ বাড়ছে নারী নিগ্রহের ঘটনা। ঋতুস্রাবের মতো একটি প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে গোপনীয়তার শেষ নেই। আমরা তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।” কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জুড়ে এই ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন সেঁটে দৃষ্টিকটু পরিবেশ তৈরির কারণ কী? অরুমিতার জবাব, “দৃষ্টিকটু ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই তো এই কাজ!”
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মধুরিমা নন্দী কিন্তু মনে করছেন, অরুমিতার এই ‘দৃষ্টি আকর্ষণে’র পদ্ধতিও আসলে নারী-পুরুষের সাম্যের ধারণার পরিপন্থী। তাঁর কথায়, “ঋতুস্রাব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তা নিয়ে অযথা গোপনীয়তার দরকার নেই। আবার স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানানোটা আসলে অসাম্যই প্রতিষ্ঠা করছে।”
এই প্রসঙ্গে কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছে গত বছর স্পেনের এক শহরের একটি ঘটনা। সেই শহরের মেয়র বলেছিলেন, “আজকাল এলিভেটরে উঠতে ভয় করে। একা পেয়ে কোনও মেয়ে যদি জামাকাপড় খুলে জড়িয়ে ধরে আর তারপর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনে!” সেই মন্তব্যের প্রতিবাদে শহর জুড়ে অন্তর্বাস ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবাদীরা। তারও আগে ভারতেরই এক প্রতিবাদ দেখে থমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। মণিপুরের তরুণী থাংজাম মনোরমার ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে একদল মহিলা বিবস্ত্র হয়ে পথে নেমেছিলেন। ব্যানার তুলে ধরেছিলেন, ‘ইন্ডিয়ান আর্মি, রেপ আস’। মনোরমার ‘মায়েদের’ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন গোটা দেশের সংবেদনশীল মানুষ।
তা বলে একেবারে ঋতুস্রাব বা স্যানিটারি ন্যাপকিনকে হাতিয়ার করে প্রতিবাদের দরকার আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। এমন নয় যে, ইদানীং ভারতীয় গণমাধ্যমে ঋতুস্রাবের মতো বিষয় নিয়ে চূড়ান্ত কোনও রাখঢাক গুড়গুড় রয়েছে। গত সপ্তাহেই ছবি শেয়ার করার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ‘ইনস্টাগ্রাম’-এ ঋতুস্রাব সংক্রান্ত একটি ছবি দিয়েছিলেন প্রবাসী ভারতীয় মহিলা কবি রূপী কৌর। ছবিটি সরিয়ে দেন ইনস্টাগ্রাম কর্তৃপক্ষ। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়ে ছবিটি ফের প্রকাশ করে ইনস্টাগ্রাম। এবং তাতে ‘লাইক’ পড়ে কয়েক হাজার।
ঋতুস্রাবের সময়ে মহিলাদের একঘরে করে রাখা, পুজোআর্চা-সহ বিভিন্ন খাওয়াদাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর প্রতিবাদ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গত বছর ‘টাচ দ্য পিক্ল’ শীর্ষক প্রচার শুরু করেছিল একটি স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রস্তুতকারী সংস্থা। তাকে সমর্থন করেছিলেন বলিউডের একাধিক তরুণী অভিনেত্রী। হিন্দি ছবি ‘পাপ্পু কান’ট ডান্স সালা’-র নায়ক বিদ্যাধর আচার্য (অভিনয়ে বিনয় পাঠক) খোলাখুলি বলেছিলেন, ওই সময়ে মেয়েদের কেমন শারীরিক সমস্যা হয়, কী ধরনের মানসিক টানাপড়েনে তাঁরা ভোগেন। সেই ছক ভাঙা দেখে নড়ে বসেছিল দর্শক।
ছক ভাঙায় অভ্যস্ত যাদবপুরও। নীতি-পুলিশির বিরুদ্ধে কিছু দিন আগে যাদবপুরের ছেলেমেয়েরাই রাস্তায় ‘হোক চুম্বন’ আন্দোলন করে একে অন্যকে চুমু খেয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে স্যানিটারি ন্যাপকিন সেঁটে দেওয়াটা কিঞ্চিত বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বলে মনে করছেন অনেকেই। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, এর পর কি শৌচাগারে নিত্যকর্মের ছবি তুলেও পোস্টার করে সাঁটা হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy