Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

মুখে প্লাস্টিক, স্কুলে ছাত্রীর মৃত্যুতে রহস্য

শৌচাগার থেকে তিন পাতার একটি ‘সুইসাইড নোট’ মিলেছে। তিনটি পাতাতেই ওই ছাত্রী লিখেছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।’

শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে কলকাতা পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।

শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে কলকাতা পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৯ ০৩:৫৯
Share: Save:

মাথায় পরানো প্লাস্টিকের ব্যাগ, গলার কাছে গিঁট বাঁধা। বাঁ কব্জিতে ক্ষত। শুক্রবার দুপুরে রানিকুঠির একটি স্কুলের শৌচাগার থেকে এমন অবস্থায় উদ্ধার হল দশম শ্রেণির এক ছাত্রীর দেহ। পুলিশ জানায়, কৃত্তিকা পাল (১৪) নামে ওই ছাত্রীকে যোধপুর পার্কের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

শৌচাগার থেকে তিন পাতার একটি ‘সুইসাইড নোট’ মিলেছে। তিনটি পাতাতেই ওই ছাত্রী লিখেছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।’ ময়না-তদন্তের রিপোর্ট না-এলেও দেহটি প্রাথমিক পরীক্ষার ভিত্তিতে লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ওই কিশোরীর। তার হাতে একাধিক ক্ষত থাকলেও এমন কোনও শিরা কাটেনি, যার ফলে মৃত্যু হতে পারে। রক্ত বেরিয়েছে তিন ফোঁটা। সুইসাইড নোটের শেষ পাতায় নিজের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছে ওই ছাত্রী। এ ভাবে নিজের ‘স্লো-ডেথ’ ঘটানোর বিষয়টি ভাবাচ্ছে পুলিশকর্তাদের।

তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, পড়াশোনা সংক্রান্ত মানসিক চাপ সামলাতে না-পেরেই এই পথ বেছে নিয়েছে কিশোরীটি। তবে তার লেখা চিঠিটির ছত্রে-ছত্রে যে ভাবে হতাশা রয়েছে, তা দেখে গোয়েন্দারা বলেছেন, পড়াশোনার বাইরে সে অন্য কোনও রকম চাপে ছিল কি না, তা-ও জানার চেষ্টা চালাবেন তাঁরা। ছাত্রীটির ল্যাপটপ পরীক্ষা করা হবে। কথা বলা হবে বাবা-মায়ের সঙ্গেও।

প্রশ্ন যেখানে

• রক্তক্ষরণে মৃত্যু নয়, শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু।
• হাত কাটলেও প্রধান শিরা কাটেনি।
• নিজের মুখে প্লাস্টিক জড়িয়ে আত্মহত্যা
কি সম্ভব?
• পুলিশের সন্দেহ, অন্য কারণও রয়েছে।
• ‘সুইসাইড নোটে’ লেখা, ‘আমার মৃত্যুর জন্য
আমি দায়ী।’

স্কুল সূত্রের খবর, ওই ছাত্রীর বাবা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি করেন। মা গৃহবধূ। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচও শিখত এই কিশোরী। পুলিশ সূত্রের খবর, এ দিন স্কুলে ইংরেজির ইউনিট টেস্ট ছিল। বেলা দেড়টা নাগাদ সে শৌচাগারে যায়। দীর্ঘ ক্ষণ না-ফিরলে সওয়া ২টো নাগাদ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। বেলা আড়াইটে নাগাদ স্কুলের এক কর্মী শৌচাগারে যান। সেই সময়ে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। তিনি শৌচাগারের পিছনের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেন, মুখে প্লাস্টিকের ব্যাগ জড়ানো এবং রক্তাক্ত অবস্থায় ওই ছাত্রী পড়ে আছে। শৌচাগারের দরজা ভেঙে ছাত্রীটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা জানান, সে মারা গিয়েছে।

লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গে হাসিমুখে স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলে ক্লাস থেকে বেরোচ্ছে ছাত্রীটি। শৌচাগারে ঢোকার মুখে কিছুটা চিন্তিত দেখিয়েছে তার মুখ। কিন্তু তদন্তকারীরা বিস্মিত তার ‘সুইসাইড নোট’-টির ভাষায়।

তাঁরা জানাচ্ছেন, চিঠিটি আগাগোড়া রহস্যময়। প্রথম দু’টি পাতা সম্ভবত আগে থেকে লিখে এনেছিল ছাত্রীটি। শেষ পাতাটি হয়তো লিখেছে মৃত্যুর আগে। যেখানে বাবা-মায়ের উদ্দেশে সে বলেছে, ‘‘আমি যখন থাকব না, তোমরা আমার অভাব বুঝতে পারবে।’’ কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও লিখেছে, তার মৃত্যুর জন্য বাবা-মাকে যেন বিরক্ত করা না-হয়।

এ দিন লালবাজারের পদস্থ আধিকারিকেরা, গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখার অফিসারেরা ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা ওই স্কুলে যান। ২০১৭ সালে এই স্কুলেই এক ছাত্রীকে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ঘিরে শহর তোলপাড় হয়েছিল। তার পর থেকে স্কুলে সিসিটিভি বসেছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা এ দিন ঘটনাস্থল থেকে একটি পেন এবং পেনসিল কাটার কয়েকটি ব্লেড পেয়েছেন।

ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দাপ্রধান মুরলীধর শর্মা বলেন, ‘‘স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ওই ছাত্রীর অভিভাবিকার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ছাত্রীটি দ্বাদশ শ্রেণির পরে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে চাইছিল। তার প্রস্তুতি সে এখন থেকেই শুরু করে দিয়েছিল। এর জন্য সে নাকি তিন মাস ঘুমোতে পারেনি।’’ কিন্তু একই সঙ্গে পুলিশকর্তারা জানাচ্ছেন, ছাত্রীটি পড়াশোনায় ভাল ছিল। তার বাবা সাহস দিতেন যে, ওই প্রতিষ্ঠানেই সে পড়ার সুযোগ পাবে। সে ক্ষেত্রে তার মনে শুধুই পড়াশোনা-জনিত চাপ ছিল, নাকি পারিবারিক কোনও ঘটনাও গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি, কেউ তার সঙ্গে সম্প্রতি দুর্ব্যবহার বা তাকে উত্ত্যক্ত করেছিল কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে তা-ও।

পড়াশোনার চাপের বিষয়টি নিয়ে অবশ্য চর্চা চলেছে সারা দিন। মনোরোগ-চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেবের মতে, লাগাতার চাপের মধ্যে পড়ুয়ারা ক্রমাগত নম্বর তোলার যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। এই চাপের জন্য মূলত বাবা-মা এবং স্কুল দায়ী। কখনও কখনও ব্যর্থতাকেও যে মেনে নিতে হয়, সেটা স্কুল শেখায় না। অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইদানীং দশম-দ্বাদশের পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পেলেও পছন্দসই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত নয়। এ বছরই উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম দশে রয়েছে ১৩৭ জন ছাত্রছাত্রী। কাজেই পড়ুয়াদের উদ্বেগ পুরোপুরি অমূলক নয়।

ওই ছাত্রীর এমন মানসিক অবস্থা কেন স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে এল না— প্রশ্ন তুলেছে ওই স্কুলের অভিভাবকদের কমিটি। দ্রুত তদন্তের পাশাপাশি স্কুলের ও অভিভাবকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথ কমিটি তৈরির দাবি জানিয়েছে তারা।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

GD Birla School Suicide Kolkata Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy