Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
summit

পাথরের খাঁজে মাথা গুঁজে রাতটা বসেই কাটিয়েছি

হিমাচলে অভিযানে গিয়ে চার দিন খোঁজ ছিল না বাংলার চার পর্বতারোহীর। নীচে যখন উদ্বেগ ও উদ্ধারের তোড়জোড়, তখন কী করছিলেন তাঁরা? কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

শীর্ষে: আলিরত্নি টিব্বার চূড়ায় (বাঁ দিক েথকে) বিনয় দাস, চিন্ময় মণ্ডল, অভিজিৎ বণিক ও দিবস দাস। ছবি: সংগৃহীত

শীর্ষে: আলিরত্নি টিব্বার চূড়ায় (বাঁ দিক েথকে) বিনয় দাস, চিন্ময় মণ্ডল, অভিজিৎ বণিক ও দিবস দাস। ছবি: সংগৃহীত

চিন্ময় মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:০৮
Share: Save:

বিদেশি পর্বতারোহীদের আগেকার সামিট রিপোর্ট দেখে মনে হয়েছিল, আলিরত্নি টিব্বা (৫৪৭০ মিটার) শৃঙ্গের শেষের প্রায় ৯০০ মিটার উঠতে কয়েক ঘণ্টা মতো লাগতে পারে। কিন্তু আদতে সারা দিন ধরে পাহাড়ে উঠেও শেষে দেখলাম, তখনও ২০০ মিটার বাকি! এ দিকে আলো কমে আসছে দ্রুত, নীচে নামারও প্রশ্ন নেই। অতএব, প্রবল ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে, পাথরের খাঁজে মাথা গুঁজে রাতটা বসেই কাটিয়ে দিয়েছি চার জন।

হিমাচলের আলিরত্নি টিব্বা শৃঙ্গে ২০১২ ও ২০১৭ সালেও অভিযানে এসেছিলাম, কিন্তু সামিট হয়নি। এই শৃঙ্গটি এতটাই পাথুরে, দুর্গম ও খাড়াই যে, বিদেশি ছাড়া ভারতীয়েরা কেউ সে ভাবে আসেন না। অভিযানের সংখ্যাও অল্প। তাই এ বার ঠিক করেছিলাম অ্যালপাইন স্টাইলে, অর্থাৎ শেরপা ছাড়া নিজেরাই অভিযান করব। সেই মতো ৭ সেপ্টেম্বর, গত বুধবার, ভোর সাড়ে ৫টায় সামিট পুশে বেরোই আমি, দিবস দাস, বিনয় দাস এবং দলনেতা অভিজিৎ বণিক। ভেবেছিলাম, ২০১৯ সালের রুটেই এগোব। কিন্তু সেই রুট খুঁজে না পেয়ে আরও উত্তরে সরে গিয়ে উঠতে শুরু করি। ক্রমশ দেখি, পথ আরও খাড়াই আর কঠিনতর হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টার সময়ে দেখি, তখনও সামিটে পৌঁছইনি আমরা!

সে সময়ে খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো (পর্বতারোহীদের ভাষায় বিভোয়াক) ছাড়া আর উপায় ছিল না। আরও কিছুটা এগিয়ে যাই, সেখানে কোনও রকমে পাথরের খাঁজে একটু বসার মতো জায়গা মেলে। সারা রাত সেখানে বসেই কাটাই। কোনও স্লিপিং ব্যাগ, টেন্ট, স্নোবুট ছাড়াই! সঙ্গের শুকনো খাবার তখন অর্ধেকেরও বেশি ফুরিয়ে গিয়েছে। কমে এসেছে জলও। লাইট সিগন্যাল দিয়ে সামিট ক্যাম্পে খবর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, যদিও সে আলো পৌঁছয়নি। সঙ্গে থাকা ওয়াকিটকিও চার্জের অভাবে কাজ করছিল না।

পরের দিন সকাল ৭টায় আবার পথ চলা শুরু। তখন সঙ্গী বলতে একটু চকলেট, কয়েকটি লজেন্স, এক প্যাকেট বিস্কুট আর আধ লিটার জল! বরফ গলিয়ে জল তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। পথে বরফ পেলে তা মুখে পুরে দিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছি। এ ভাবেই গত বৃহস্পতিবার পৌঁছই কাঙ্ক্ষিত সামিটে। তখন সকাল পৌনে ৯টা।

ফেরার পথে অন্য রুটে নামতে গিয়ে আবার আর এক বিপদ! সে পথে ৮৫-৯০ ডিগ্রি খাড়াই দেওয়াল, আশপাশ থেকে ভয়ঙ্কর শব্দে অনবরত পাথর পড়ছে। একটা পাথর আমাদের দিকে গড়িয়ে এলেই চিত্তির! এ দিকে সারা দিন খাবার আর জল পেটে পড়েনি, তখন মাথা ঘুরতে শুরু করেছে চার জনেরই। কোনও মতে সন্ধ্যা নামার মুখে ফিরে আসি সামিট ক্যাম্পে। এসে দেখি, ক্যাম্প খালি, রাঁধুনি লাকপা শেরপা নেমে গিয়েছে নীচে। সম্ভবত বেসক্যাম্পে বাকি দুই সদস্যকে খবর দিতে।

পরের দিন, শুক্রবার পুরো বিশ্রাম নেওয়া ছাড়া গতি ছিল না। শনিবার নিজেরাই নীচে নামা শুরু করি। তাঁবু, সরঞ্জাম সব মিলিয়ে তখন এক-এক জনের পিঠে ৩০ কেজি ওজনের মালপত্র। হিমবাহের কাছে এসে দেখি, চার দিনেই গলে গিয়েছে বরফের সেতুগুলো! ফলে ফের রুট ওপেন করার পালা। এর পরে রবিবার সকালে ক্যাম্প ১-এ বসে যখন খাবার খাচ্ছি, হঠাৎ শুনি চপারের আওয়াজ। দেখি, চারপাশে চক্কর কাটছে হেলিকপ্টার। একটু পরে চলে এল উদ্ধারকারী দলও। তখনই জানতে পারি, আমাদের খবর না পেয়ে কী হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে গিয়েছে নীচে!

(পর্বতারোহী)

অন্য বিষয়গুলি:

summit Moutaineering Mount Ali Ratni Tibba
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy