প্রতীকী ছবি।
‘‘রেজিস্ট্রেশন আছে?’’
প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিভ্রান্ত, নিজেকে পঞ্চসায়রের একটি হোমের মালিক বলে দাবি করা দুর্গা নস্কর। এর পরে অনেক খুঁজে তিনি বার করে আনলেন একটি কাগজ। তাতে উপরের দিকে ঠিকানা-সহ মোটা হরফে লেখা, ‘মা কালী বৃদ্ধাবাস’। নীচে আবেদনকারীর নাম, ঠিকানা লেখার জায়গা-সহ লেখা রয়েছে ‘বৃদ্ধাবাসে থাকার আবেদনপত্র’।
এটাই নথিভুক্তির কাগজ? দুর্গা বললেন, ‘‘এটাই আছে। এতে একটা নম্বর দেওয়া আছে। সেটাই মনে হয় রেজিস্ট্রেশন নম্বর। এই হোমের মালিক এখন আমি। আগের মালিক রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে যাননি।’’ হোম চালানোর পরিকাঠামোই বা কোথায়? মহিলার উত্তর, ‘‘১৫ বছর ধরে এই হোম চলছে। অত নিয়মকানুন মানা যায় না।’’
পঞ্চসায়রেরই ‘সেবা ওল্ড এজ হোম’ নামে একটি বৃদ্ধাবাস থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক মহিলা গণধর্ষিতা হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। কোনও রকম পরিকাঠামো এবং নথিভুক্তি ছাড়াই ওই হোমের মোট ১২টি শাখা চলছিল বলে তদন্তে জানতে পেরেছে লালবাজার। এর পরেই রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতরের সচিবকে চিঠি পাঠিয়ে সেই হোমের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানিয়েছে লালবাজার। ওই হোমের সব ক’টি শাখাই বন্ধ করে দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে বলে সোমবার জানান লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা।
শহরে ঘুরে দেখা গেল, কোনও রকম নথিভুক্তি বা পরিকাঠামো ছাড়াই রমরমিয়ে চলছে প্রচুর হোম। তাদের নিরাপত্তার বালাই নেই। ন্যূনতম যে পরিচ্ছন্নতা থাকা দরকার, তা-ও চোখে পড়ল না বেশির ভাগ জায়গায়। কোথাও তেল চিটচিটে চৌকিতে শোয়ানো হয়েছে
আবাসিকদের। কোথাও এক জনের জায়গায় আছেন দু’জন। কয়েকটি হোমের শৌচাগারের দুর্গন্ধে ঘরের ভিতরেই টেকার উপায় নেই। বাঘা যতীনের একটি হোমে ঢুকে দেখা গেল, এক বৃদ্ধ সমানে কাউকে ডেকে চলেছেন। কাছে যেতেই জানালেন, সকালের দিকে বিছানাতেই শৌচকর্ম করে ফেলেছেন। দুপুর গড়িয়ে গেলেও তা কেউ সাফ করে দেননি। সিঁথির মোড়ের ‘সন্ধ্যা ওল্ড এজ হোম’-এ আবার মেঝেয় পড়ে ছিল এক আবাসিকের বমি। তার পাশেই ঢেকে রাখা হয়েছে আর এক আবাসিকের খাবার। খাইয়ে না দিলে সেই বৃদ্ধা খেতে পারেন না। হোমের কর্মী কবিতা সামন্ত বললেন, ‘‘বমি পড়ে থাক, আগে দিদাকে খাইয়ে নিই। এক জনের পক্ষে ১৫ জনকে সামলানো সম্ভব?’’ কসবার একটি হোমে আবার তিন বৃদ্ধার ‘বেড সোর’ হয়ে গিয়েছে। হোমের মালিক প্রদীপ্ত হাজরা বললেন, ‘‘দু’হাজার টাকা করে নিই। বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’’
পূর্ব যাদবপুরে আবার স্বামী-স্ত্রী মিলে খুলেছেন বৃদ্ধাবাস ‘আলোর দিশা’। এমনিতে সাফসুতরো হলেও সেখানে নেই কোনও সিসি ক্যামেরা বা নিরাপত্তাকর্মী। রাখা হয়নি আবাসিকদের নামের খাতাও। তাঁদের বাড়ি থেকে যে ওষুধ দিয়ে যাওয়া হয়, তা যাচাই করে নেওয়ারও লোক নেই। মালকিন শুভ্রা মজুমদার বলেন, ‘‘কারও বাড়ির লোক ইচ্ছে করে ভুল ওষুধ দিয়ে গেলেও বুঝতে পারব না ঠিকই, তবে হোমটা কয়েক দিন আগেই করেছি। আমাদের ব্যবসায়িক অনুমতিও আছে।’’ একই দাবি চেতলার বৃদ্ধাবাস ‘নবনীর’-এর মালিকেরও। সেখানেও অবশ্য বয়স্কদের নিরাপত্তার জন্য নেই সিসি ক্যামেরা।
লালবাজার অবশ্য জানাচ্ছে, কোনও হোমের বিরুদ্ধেই সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে না তারা। হোমগুলি দেখে সমস্যা বুঝলে সমাজকল্যাণ দফতরকে জানাবে পুলিশ। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘হোমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বলতে তো মাত্র ৩০০ টাকা জরিমানা, নয় তিন মাসের জেল। এতে কাজে হবে কি?’’ রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বৃদ্ধাবাস চালানোর জন্য কোনও নির্দিষ্ট নথিভুক্তির পদ্ধতি নেই। তবে মহিলা, শিশু বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের রাখতে সমাজকল্যাণ দফতরের অনুমতি নিতে হয়। মেনে চলতে হয় দফতরের নিয়মও।’’ ওই দফতরের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘হোমগুলি নিয়ম মানছে কি না, দেখা হবে। পঞ্চসায়রের ঘটনায় আমাদের দফতরের দু’জন গিয়ে সেবা ওল্ড এজ হোমটি দেখে এসেছেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’’
এই ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার ভয়ই দেখা গেল পঞ্চসায়রের ময়ূরাক্ষী হোমে। ওই হোমের কর্মীরা বলে দেন, ‘‘কয়েক বছর আগে হোম চলত। এখন বন্ধ।’’ ভিতরে ঢুকে অবশ্য দেখা গিয়েছে, একের পর এক চৌকিতে শুয়ে প্রবীণেরা। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘খুব ঠান্ডা লাগছে। একটা চাদর দেবে? সকাল থেকে ডেকে ডেকে কাউকেই পাচ্ছি না।’’
বিপদ ঘটলে কাউকে পাওয়া যাবে তো? উত্তর নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy