Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
কবরডাঙা

জলাজমিতে টাকার খনি, লুটতে টক্কর তুঙ্গে

বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই নিচু। বছরের বেশির ভাগ সময়ে জল জমে থাকে। বড় ঘাস, হোগলায় ভর্তি। হরিদেবপুরের কবরডাঙা কিংবা একটু ভিতরে এমন একের পর এক জমি। সাদা চোখে দেখলে অনেকেই কিনতে চাইবেন না।

হরিদেবপুরের সেই পানশালার সামনে বসেছে পুলিশি প্রহরা। —নিজস্ব চিত্র।

হরিদেবপুরের সেই পানশালার সামনে বসেছে পুলিশি প্রহরা। —নিজস্ব চিত্র।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৫
Share: Save:

বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই নিচু। বছরের বেশির ভাগ সময়ে জল জমে থাকে। বড় ঘাস, হোগলায় ভর্তি।

হরিদেবপুরের কবরডাঙা কিংবা একটু ভিতরে এমন একের পর এক জমি। সাদা চোখে দেখলে অনেকেই কিনতে চাইবেন না। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জমিগুলো টাকার খনি! যা ঘিরে গজিয়ে উঠেছে জমি-ইমারতি ব্যবসার সিন্ডিকেট। ‘ব্যবসা’ বাড়ানোর তাগিদে শুরু হয়েছে এলাকা দখল। পিছনে শাসকদলের একাধিক নেতার মদতও রয়েছে বলে অভিযোগ।

বুধবার রাতে কবরডাঙায় পানশালার সামনে বন্দুকবাজি ও খুনের নেপথ্য কারণ হিসেবেও দু’টি সিন্ডিকেটের টক্করের দিকে আঙুল তুলছে স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের একাংশ। এই মহলের বক্তব্য: ডাবলু সিংহের সিন্ডিকেট আর কালী-দুর্গার সিন্ডিকেটের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে গোলমাল চলছিল। পানশালায় নর্তকীকে নিয়ে বিবাদটা আসলে বারুদের স্তূপে দেশলাই জ্বালিয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশের দাবি, বিজয়-নান্টি-বাপ্পার মতো ডাবলু-সিন্ডিকেটের ছেলেরা সে রাতে কালীকে মারতেই এসেছিল। সামনে পড়ে যায় রাহুল মজুমদার ওরফে রাজা। শুক্রবার এক প্রত্যক্ষদর্শীও বলেন, ‘‘রাজার ঠিক পিছনে ছিল কালীদা। রাজা গুলি খেতেই ও তৃণমূল পার্টি অফিসের ভিতরে সেঁধিয়ে যায়।’’ কালীও স্বীকার করেছেন, বুধবার রাতে তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। ‘‘ওই বারের পাশে আমার বাড়ি। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ গোলমাল শুনে ওখানে গিয়েছিলাম।’’— দাবি তাঁর।

পুলিশ ও স্থানীয়-সূত্রের খবর, কালী সিংহ ও দুর্গা সিংহ আদতে দু’ভাই। কালী এক সময় অটো চালাতেন, দুর্গা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। পালাবদলের পরে ওঁরা সিন্ডিকেটের মাথা হয়ে ওঠেন। জমি দখল থেকে শুরু করে নির্মাণস্থলে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ— সবটাই ছিল ওঁদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু কালী-দুর্গার খাসতালুকে ডাবলু ক্রমশ থাবা বসাচ্ছিল। তাতেই গোলমাল।

কে এই ডাবলু?

জানা গিয়েছে, হরিদেবপুরের সোদপুরের বাসিন্দা ডাবলু একদা বাসের কন্ডাক্টরি করত। বছর কয়েক আগে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসায় নামে। পুলিশ বলছে, ডাবলুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। ইদানীং রেনিয়া-সোনারপুরের কিছু ছেলে তার দলে ভিড়েছে। পুলিশের দাবি, কবরডাঙা-কাণ্ডের অভিযুক্তেরা অধিকাংশই সোনারপুর-রেনিয়ার বাসিন্দা। স্থানীয় তৃণমূল-সূত্রের খবর, সম্প্রতি একটি জলাজমি বোজানো নিয়ে দু’পক্ষে বড় ঝামেলা হয়েছিল। ‘‘এমনও হতে পারে, গোলমাল পাকানোর উদ্দেশ্যেই ছেলেগুলো বারে ঢুকে নর্তকী নিয়ে ঝগড়া লাগিয়েছিল!’’— পর্যবেক্ষণ সূত্রটির।

পুলিশের কারও কারও দাবি, এমনটা যে হতে পারে, আগেই তার আঁচ মিলেছিল। ওঁদের বক্তব্য: কবরডাঙার দু’টি পঞ্চায়েত এলাকা সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার আওতায় এসেছে। তার সুবাদে জমির দাম বেড়েছে তরতরিয়ে। ফলে সিন্ডিকেটগুলো আরও মরিয়া হয়ে জমি কব্জা করতে নেমে পড়েছে। জল জমে থাকা জমি নিয়ে কী ভাবে কারবার চলে?

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সিন্ডিকেটের ব্যবসা শুরু হয় জমি দখল দিয়ে। ভয় দেখিয়ে নিচু জমি কিনে নেওয়া হয় লাখ পাঁচেক টাকা কাঠা দরে। তা মাটি ফেলে ভরাট করে কাঠাপিছু অন্তত ১৫ লাখে বিক্রি করা হয় প্রোমোটারকে। বহুতল নির্মাণের ইট-বালি সাপ্লাইয়ের বরাত আবার সিন্ডিকেটই আদায় করে।

অর্থাৎ দু’দিকেই মোটা মুনাফার হাতছানি। শুক্রবার কবরডাঙা ঘুরেও জমি-কারবারের রমরমার আভাস মিলেছে। কবরডাঙা মোড় থেকে এমজি রোড ধরে এগোলে রাস্তার ধারে টিন-ঘেরা বড় বড় জমি। কী রয়েছে ভিতরে?

উঁকি মেরে দেখা গেল, কোথাও জলাজমি ভরাট হচ্ছে, কোথাও বা ভরাট শেষ! স্থানীয় অনেকে জানাচ্ছেন, নতুন মাথা তোলা বহুতলগুলির অধিকাংশই জলাজমির উপরে। ‘‘রাত নামলেই মাটিবোঝাই লরি ঢুকতে থাকে। রাতভর মাটি ফেলে ভোরের আগে চলে যায়।’’— বলেন এক বাসিন্দা। প্লট করে জমি বিক্রির হরেক বিজ্ঞাপন সমেত পোস্টার-প্ল্যাকার্ডেরও কমতি নেই!

কিন্তু প্রশ্ন, গোলমালের আগাম আঁচ থাকতেও পুলিশ সতর্ক হয়নি কেন? পুলিশ-সূত্রের যুক্তি: প্রায় প্রতিটা সিন্ডিকেটের মাথার উপরে শাসকদলের নেতাদের হাত। ‘‘ব্যবস্থা নেওয়ার মতো বুকের পাটা কার আছে?’’— প্রশ্ন এক অফিসারের। শোনা গেল, মাস সাতেক আগে হরিদেবপুর থানার এক অফিসার সিন্ডিকেটকে শায়েস্তা করতে কোমর বেঁধেছিলেন। কিন্তু আচমকা লালবাজার তাঁকে সরিয়ে দেয়। স্থানীয় সূত্রের খবর: বছরখানেক আগেও এলাকার এক তৃণমূল-শ্রমিক নেতার সঙ্গে কালী-দুর্গাকে ঘুরতে দেখা যেত। তাঁরা হঠাৎই দল পাল্টে ওই নেতার বিরোধী গোষ্ঠীতে চলে যান। দু’ভাই ইদানীং তৃণমূল কাউন্সিলর রঘুনাথ পাত্রের ঘনিষ্ঠ বলেই স্থানীয় সূত্রের দাবি, যে রঘুনাথবাবু আবার দলীয় রাজনীতিতে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। রঘুনাথবাবুও এ দিন বলেছেন, ‘‘কালী অটো চালায়। ও পানশালা বা জমির সিন্ডিকেট— কিছুতেই জড়িত নয়। ও আমাদের দলেরও কর্মীও। নিয়মিত পার্টি অফিসে বসে।’’

অন্য দিকে ডাবলুর মাথাতেও শাসকদলের ছত্রচ্ছায়া বহাল বলে পুলিশের দাবি। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘ও বরাবর রুলিং পার্টির স্নেহধন্য। বাম জমানায় সিপিএম কাউন্সিলরের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। এখন তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ।’’ এলাকার মানুষ বলছেন, ১২২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ডাবলু স্থানীয় তৃণমূল নেতা শুভাশিস চক্রবর্তীর কাছের লোক। যদিও শুভাশিসবাবুর অভিযোগ, এ সব অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।

চাপান-উতোরের শেষ নেই। তারই মাঝে দিব্যি ভরাট হয়ে রক্তপাতের নিত্য-নতুন জমি তৈরি করে দিচ্ছে কবরডাঙার জলাভূমি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy