যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডু। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুন্ডুর মৃত্যুরহস্যের তদন্তে সক্রিয় পুলিশ। যত সময় যাচ্ছে, ততই একের পর এক নতুন তথ্য প্রকাশ্যে আসছে। পাশাপাশি, আরও স্পষ্ট হচ্ছে ‘র্যাগিং তত্ত্ব’। বুধবার রাতে হস্টেলে স্বপ্নদীপের উপর অত্যাচার করা হয়েছিল। আদালতে জোর দিয়েই এই দাবি করেছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদবপুরের সেই প্রাক্তনী সৌরভ চৌধুরীকে শনিবার ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তবে ‘অত্যাচারে’ অনেকের হাত ছিল বলেই দাবি পুলিশের। শনিবার আদালতে পুলিশের তরফে আইনজীবী সৌরীন ঘোষাল জানিয়েছেন, গোটা ঘটনায় একটা অত্যাচারের গল্প উঠে আসছে। তাতে সৌরভও জড়িত। সঙ্গে আরও কয়েক জন জড়িত থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ‘র্যাগিং’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি তিনি। পড়ুয়াদের বয়ান থেকেই এই ‘অত্যাচারের গল্প’ উঠে এসেছে বলে দাবি তাঁর। স্বপ্নদীপের পরিবারের তরফে প্রথম থেকেই র্যাগিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাঁর মামা অরূপ কুন্ডু অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘র্যাগিং অবশ্যই হয়েছে। র্যাগিং না হলে এমন কী করে হয়? ও তো পাগল নয়।’’ পরে স্বপ্নদীপের বাবা খুনের অভিযোগ দায়ের করেন।
ধৃত সৌরভের পরিবার অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁর মা প্রণতি চৌধুরী বলেন, ‘‘আমার ছেলে নির্দোষ। ওকে ফাঁসানো হয়েছে। স্বপ্নদীপের বাবা-মা ফাঁসিয়েছে। আমার ছেলের নাম বার বার নেওয়া হচ্ছে।’’ সৌরভ নিজেও শনিবার আদালত থেকে বেরোনোর সময় বলেন, ‘‘আমি নিরপরাধ।’’ তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে যে প্রাক্তনীদের দাপট চলে, তা অনেকেই দাবি করছেন। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হস্টেলের ঘর ছাড়েন না অনেক পড়ুয়া। তাঁরাই সাধারণত র্যাগিংয়ের ‘নেতৃত্বে’ থাকেন। রাতের পর রাত নতুন ছাত্রদের সঙ্গে আলাপের নামে তাঁদের ‘ইন্ট্রো’ নেওয়া হয়। সঙ্গে চলে বিবিধ অত্যাচার। হস্টেল থেকে এই প্রাক্তনী তথা অবৈধ আবাসিকদের সরানোর দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে। পুলিশ সূত্রে দাবি, হস্টেলে বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রয়েছে। যেখানে প্রাক্তনীরাই সর্বেসর্বা। সৌরভও তেমনই এক প্রাক্তনী বলে দাবি করেছে পুলিশ। হস্টেলে তাঁর দাপট সবচেয়ে বেশি। সেই কারণেই তাঁর কথায় অন্য এক ছাত্রের ‘অতিথি’ হিসাবে হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল স্বপ্নদীপের।
গত রবিবার থেকে হস্টেলে থাকতে শুরু করেছিলেন স্বপ্নদীপ। তিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসও করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের এ-২ ব্লকের ৬৮ নম্বর ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের অতিথি হিসাবে থাকছিলেন তিনি। বুধবার রাতে তিন তলার বারান্দা থেকে স্বপ্নদীপ নীচে পড়ে যান। তাঁকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ভোরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত ৯টা নাগাদ মাকে ফোন করেছিলেন স্বপ্নদীপ। ফোনে বার বার তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছিলেন। শুক্রবার স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ কুন্ডু জানান, বুধবার রাতে যখন র্যাগিং চলছিল, সেই সময় তাঁরা স্বপ্নদীপের মোবাইলে ফোন করেছিলেন। কিন্তু সেই ফোন কেউ তোলেননি। বরং, ও দিক থেকে ঘুরিয়ে ফোন করা হয়েছিল। স্বপ্নদীপের বাবা বলেন, ‘‘আমাদের ফোন রিসিভ করেনি। ওদের ফোন থেকে আমাদের ফোন করেছিল। ওকে (স্বপ্নদীপকে) সিনিয়রেরা ফোনে বলতে বলছিল, ‘বল ভাল আছিস’। আর ছেলে ফোনে মা-বাবা করে আর্তনাদ করছিল। ক্রমাগত বলে যাচ্ছিল, ‘মা, আমি ভাল নেই। আমাকে নিয়ে যাও। ওর দাদাও ফোন ধরে কথা বলেছিল। আমার ছেলে অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। ওকে কখনও এ রকম আচরণ করতে দেখিনি।’’
সৌরভের বয়ান বদল
পুলিশ সূত্রে দাবি, জেরায় বার বার বয়ান বদল করছেন সৌরভ। তিনি অসংলগ্ন কথাও বলছেন। পুলিশকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টাও করছেন বলে দাবি তদন্তকারীদের একাংশের। তথ্য গোপনের অভিযোগও উঠছে সৌরভের বিরুদ্ধে। তাঁর কাছ থেকে সত্য ঘটনা জানার চেষ্টা করবে পুলিশ। সে কারণেই হেফাজতে চাওয়া হয়েছে সৌরভকে।
‘আপনার ছেলে ভাল আছে’
স্বপ্নদীপ বুধবার রাতে যখন তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছিলেন সৌরভ। ফোনে তিনি স্বপ্নদীপের মাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘‘আপনার ছেলে ভাল আছে।’’ অভিযোগ, এর পর ফোনটি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন সৌরভ। পরে অন্য পড়ুয়াদের ফোন থেকে স্বপ্নদীপের বাড়িতে যোগাযোগ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তকারীরা এমনটাই জানতে পেরেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে ফোনে এ কথা জানিয়েছেন স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ এবং মা স্বপ্নাও।
‘ঠান্ডা মাথার খুনি’
ধৃত সৌরভকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ বলে অভিযোগ করেছেন রামপ্রসাদ। শুক্রবার সংবাদমাধ্যমের সামনে এই অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর দাবি, গত ৩ অগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একটি চায়ের দোকানে সৌরভের সঙ্গে আলাপ হয়। সৌরভ তাঁকে জানান, ২০২২ সালে তিনি এমএসসি পাশ করেছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, সৌরভের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনায়। স্বপ্নদীপের বাবাকে সৌরভই জানান, হস্টেলে গেস্ট হয়ে থাকা যায়। নিম্নবিত্ত পরিবার স্বপ্নদীপের। তাই সৌরভের কথায় ভরসা পেয়েছিলেন রামপ্রসাদ। সৌরভের হাত ধরে বলেছিলেন, ছোট ভাইয়ের মতো স্বপ্নদীপকে দেখতে। তিনি এ-ও জানান, সৌরভই যাদবপুরের মেন হস্টেলে মনোতোষ নামে এক ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন স্বপ্নদীপের।
সৌরভের আইনজীবীর সওয়াল
আলিপুর আদালতে সৌরভের পক্ষে সওয়াল করেন তাঁর আইনজীবী অরিন্দম দাস। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘‘সৌরভ স্বপ্নদীপের সহপাঠী, রুমমেট, বন্ধু নন। সৌরভের ফোন থেকে ফোনও করা হয়নি। কার ফোন থেকে কথা বলা হয়েছিল, সেটা দেখা হোক। স্বপ্নদীপের বাবা সৌরভকে চিনতেন না। হয়তো ছেলের কাছ থেকে শুনেছেন।’’
পুলিশি হেফাজতে সৌরভ
শনিবার সৌরভকে আলিপুর আদালতে হাজির করিয়ে পুলিশ আগামী ২৫ অগস্ট পর্যন্ত নিজেদের হেফাজতে রাখতে চেয়েছিল। বিচারক ২২ তারিখ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজত মঞ্জুর করেছেন। অর্থাৎ, আগামী ১০ দিন পুলিশি হেফাজতেই থাকতে হবে সৌরভকে।
‘আমি নিরপরাধ’
সৌরভকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়েছিল শনিবার। আদালত থেকে গাড়িতে তোলার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি দু’টি মাত্র শব্দ বলেন। তাঁর দাবি, তিনি নির্দোষ। তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে কি না, জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। উত্তরে সৌরভ বলেন, ‘‘আমি নিরপরাধ।’’ স্বপ্নদীপের মৃত্যুর পর থানায় পরিবারের তরফে যে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে সৌরভের নামের উল্লেখ আছে।
‘অত্যাচারের গল্প পাচ্ছি’
সৌরভের মামলার শুনানি চলাকালীন আদালতে সরকারি কৌঁসুলি সৌরীন জানান, স্বপ্নদীপের উপর যে অত্যাচার হয়েছিল, তা এক প্রকার নিশ্চিত। তাঁর যুক্তি, তিন জনের বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনার পুনর্নির্মাণ করানোর আর্জিও জানান তিনি। একই সঙ্গে আদালতে তিনি দাবি করেন, দু’টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে সৌরভের ফোনও রয়েছে। ওই ফোনের ‘কল ডিটেলস্’ খতিয়ে দেখা হবে। তিনি এ-ও বলেন, ‘‘একটা অত্যাচারের গল্প পাচ্ছি। যাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁর নামও আসছে।’’ মনে করা হচ্ছে, র্যাগিং তত্ত্বেই সায় রয়েছে সৌরীনের। যদিও ‘র্যাগিং’ শব্দটি উচ্চারণ করতে চাননি সরকারি আইনজীবী। তিনি ‘অত্যাচার’ (টর্চার) শব্দটিই বার বার উল্লেখ করেছেন।
কাদের জিজ্ঞাসাবাদ
স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। শুক্রবার ছ’জন এবং শনিবার আরও সাত জনকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়। তাঁরা সকলেই হস্টেলের আবাসিক। বুধবার ঘটনাস্থলে উপস্থিতও ছিলেন তাঁরা। তাঁদের বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। পাশাপাশি, হস্টেলের এক নিরাপত্তারক্ষীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। রবিবার আরও কয়েক জনকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। প্রাক্তনী হওয়া সত্ত্বেও বেআইনি ভাবে হস্টেলে থাকতেন, এমন ২০ জনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে যাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে ‘জড়িত’ বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁদের রবিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
মায়ের হাহাকার
ছেলের খুনিদের ফাঁসির সাজা চাইছেন স্বপ্নদীপের মা স্বপ্না। তাঁর কথায়, ‘‘জীবনে কখনও কারও মৃত্যু কামনা করিনি। কিন্তু সৌরভের ফাঁসি চাই। ওরা ছাড়া পেয়ে যাবে না তো? সৌরভের ফাঁসি হলে ওর মায়ের কোল খালি হবে। কিন্তু আমার বুকের জ্বালা মিটবে। আমি কোনও দিন কারও ক্ষতি চাইনি। এই প্রথম চাইছি, কারও মৃত্যু হোক।’’
শিশু সুরক্ষা কমিশনের চিঠি
স্বপ্নদীপের মৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সিভি আনন্দ বোসকে চিঠি দিয়েছে রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন। ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত এবং তার রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে রাজ্যপালের কাছ থেকে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার বীনিত গোয়েলকেও চিঠি দিয়েছে কমিশন। হস্টেলের বেআইনি আবাসিকদের তালিকা, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে চাওয়া হয়েছে। কী ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
অধরা পাঁচ রহস্য
পুলিশ সূত্রে খবর, মৃত্যুর রাতে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছিলেন স্বপ্নদীপ। তিনি নাকি বার বার বলছিলেন, ‘‘আই অ্যাম নট গে’’ (আমি সমকামী নই)। উদ্ভ্রান্তের মতো বারান্দা ধরে এ দিক সে দিক হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। প্রশ্ন উঠছে, কেন হস্টেলে এই আচরণ করছিলেন স্বপ্নদীপ? তাঁর উপর কি শারীরিক বা মানসিক ভাবে কোনও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল? উত্তর মেলেনি। একই ভাবে, কেন স্বপ্নদীপ সে রাতে গামছা পরে ছিলেন, কেন তাঁর দেহে অন্য কোনও পোশাক ছিল না, তারও উত্তর মেলেনি। স্বপ্নদীপ কী ভাবে বারান্দা থেকে পড়ে গেলেন? কেউ কি তাঁকে ধাক্কা মেরেছিল? তিনি নিজেই কি ঝাঁপ দিয়েছিলেন? পড়ার আগে কাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন স্বপ্নদীপ? কী নিয়েই বা কথা হয়েছিল? এখনও সে সব কিছুই জানা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার রাতে স্বপ্নদীপকে নিয়ে একদল পড়ুয়া হাসপাতালে গিয়েছিল, আর একদল ব্যস্ত ছিল বৈঠকে। কী নিয়ে আলোচনা হল সেখানে? প্রশ্নের উত্তর অধরা। এ ছাড়াও, ২০২২ সালে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও সৌরভ কী ভাবে হস্টেলের বৈঠকে অংশ নিলেন, কেনই বা তিনি মেস কমিটিতে থেকে গিয়েছেন? সে সব প্রশ্ন উঠেছে।
ডায়েরি রহস্য
হস্টেলে যে ৬৮ নম্বর ঘরে স্বপ্নদীপ থাকতেন, সেখান থেকে একটি হলুদ রঙের ডায়েরি পেয়েছে পুলিশ। সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ডায়েরিটি কার, তাতে কী আছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy