এই ধরনের খবরের ক্ষেত্রে আসল ছবি প্রকাশে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকে। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
২০১৪ সালের এক রাতে ঘুমন্ত রূপতাজ ইয়াসমিনের উপরে অ্যাসিড ছুড়েছিল তার বড়দিদির দেওর। বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করায় নাক, কান-সহ দেহের একাধিক অংশ ঝলসে গিয়েছিল বছর বারো-তেরোর সেই কিশোরীর। ২০১৭ সালে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ন্যূনতম তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পান রূপতাজ। যদিও ২০১৯ সালে ক্ষতিপূরণ বাবদ তাঁকে মোট ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল ‘ক্রিমিনাল ইনজুরিজ় কমপেনসেশন বোর্ড’। অ্যাসিড হামলার এক দশক পরে, চলতি মাসে অবশেষে রাজ্য সরকারের লিগাল সার্ভিস অথরিটির (এসএলএসএ) তরফে তিনি পেয়েছেন প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের বাকি ১২ লক্ষ টাকা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার তনুজা খাতুনের উপরেও অ্যাসিড হামলা হয়েছিল ঘুমন্ত অবস্থায়। প্রেম প্রত্যাখ্যান করার ‘অপরাধে’। ২০১০ সালের সেই ঘটনার পরে ন্যূনতম তিন লক্ষ টাকা পেতেই সময় লেগেছিল ১০ বছর! এর পরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে ফের ক্ষতিপূরণের জন্য হাই কোর্টে মামলা করেন তনুজা। চলতি মাসে হাই কোর্টের নির্দেশে তাঁকেও আরও সাত লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এসএলএসএ।
রূপতাজ-তনুজারা যদিও ব্যতিক্রম। কারণ, অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মীরা বলছেন, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকেন আক্রান্তেরা। কেউ কেউ আবার ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পেলেও বিভিন্ন কারণে তাঁরা যে আরও বেশি ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন, সেটুকুও জানতে পারেন না। তাই সেই দাবিও জানান না। ফলে চিকিৎসা থেকে শুরু করে জীবনের মূল স্রোতে ফেরা— সবটাই ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে তাঁদের কাছে।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে রূপতাজ পাশে পেয়েছিলেন আর এক অ্যাসিড আক্রান্ত, দিল্লির শাহিন মালিকের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ব্রেভ সোল ফাউন্ডেশন’-কে। ওই সংস্থার কলকাতা শাখায় কর্মরত, আর এক অ্যাসিড আক্রান্ত এবং সমাজকর্মী মনীষা পৈলান বলছেন, ‘‘অ্যাসিড হামলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ক্ষতিপূরণের পরিমাণ তিন লক্ষ হলেও ক্ষয়ক্ষতি ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে এ নিয়ে প্রচার চালাতে গিয়ে দেখেছি, অনেকে ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটাই জানেন না। বহু বছর আগে আক্রান্তদের কেউ কেউ কোনও ক্ষতিপূরণই পাননি। ন্যূনতম ক্ষতিপূরণ পেতেও অনেকের বহু বছর লেগেছে। চিকিৎসা, লেখাপড়া-সহ একাধিক কারণে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণও যে পাওয়া যায়, সেটাও অনেকে জানেন না। ২০২২ সালে হাওড়ার সাঁকরাইলের অ্যাসিড আক্রান্ত সইফুল শেখ যেমন এত দিনে আমাদের সংস্থার কাছে এসেই প্রথম ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে জানতে পেরেছেন!’’ অথচ, রূঢ় বাস্তব হল, ক্ষতিপূরণ না পেয়ে অনেকেই চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্ব হারান। আবার অনেকেরই থমকে থাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার।
কলকাতা হাই কোর্টে রূপতাজের আইনজীবী দিবায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, রূপতাজের জন্য ২০১৯ সালে মোট ১৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছিল ‘ক্রিমিনাল ইনজুরিজ় কমপেনসেশন বোর্ড’। কিন্তু তা বহু দিন ধরে বাস্তবায়িত হয়নি। এ নিয়ে এসএলএসএ, ডিএলএসএ (ডিস্ট্রিক্ট লিগাল সার্ভিস অথরিটি)-র কাছে চলতি বছরে আবেদন করা হলেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি বলে অভিযোগ। এর পরেই হাই কোর্টে মামলা করা হয়। দিবায়নের কথায়, ‘‘রূপতাজের জন্য এই বাকি ১২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় যুদ্ধজয়ের চেয়ে কিছু কম নয়। তবে, এখানেই শেষ নয়। ওঁর জন্য হয় পেনশন অথবা চাকরির ব্যবস্থা করা হোক— এই দাবিতে হাই কোর্টে মামলা এখনও চলছে।’’
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি, আক্রান্তদের তিন লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়। পরে এই রায়ের বেশ কিছু সংশোধনও হয়। পরবর্তী কালে নালসা কমিটির প্রকল্প অনুযায়ী, আক্রান্ত কোনও কিশোর-কিশোরী হলে, মুখের কোনও অংশের বিকৃতি ঘটে থাকলে বেশি ক্ষতিপূরণও পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া, ঘটনার এক মাসের মধ্যে এক লক্ষ ও ৯০ দিনের মধ্যে বাকি টাকার ৫০ শতাংশ দিয়ে দিতে হবে। ‘‘কিন্তু এই নির্দেশ কেউ মানছে না। ফলে অ্যাসিড হামলার পরে প্রথম ক্ষতিপূরণের টাকা পেতেই অনেকের তিন-চার বছর লেগে যাচ্ছে।’’— বলছেন ওই আইনজীবী।
কিন্তু কেন এই পরিস্থিতি? ২০২২ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মধ্যে অ্যাসিড হামলায় শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৫ সালে অ্যাসিড হামলার শিকার মনীষার মতে, অ্যাসিড হামলার মতো ঘৃণ্য ঘটনাকে আজও অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার ‘চেষ্টা’ হয়। আজও খোলা বাজারে অবাধে অ্যাসিড বিক্রি হয়। গ্রামে গ্রামে গিয়ে গান, লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাই এ নিয়ে প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার এবং পুলিশকে আরও সংবেদনশীল করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন মনীষা। যদিও রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘খালি চোখে তো ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় না। নিশ্চিত হতে গেলে বেশ কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। খালি চোখে অ্যাসিড হামলা বলে মনে হলেও মামলায় লেখার ক্ষেত্রে পুলিশের কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। তাই এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরেই পুলিশ
পদক্ষেপ করে।’’
আইনজীবী দিবায়ন বলছেন, ‘‘ডিএলএসএ-কে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, অ্যাসিড হামলার ঘটনা গ্রামেই বেশি হয়। তাই আক্রান্তেরা প্রথমে তাদের কাছেই আসেন। তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে সব সময়ে হাই কোর্ট, এসএলএসএ-র মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে কেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy