ফাইল চিত্র
‘‘কী করব বলুন! আমরা তো যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’’— বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ট্র্যাফিক কন্ট্রোল রুমের পুলিশকর্মীর গলাতেও স্পষ্ট হতাশা। যানজটদীর্ণ অবরুদ্ধ ভিআইপি রোডে আটকে পড়া অ্যাম্বুল্যান্সের ভিতর শোয়া বাবার দিকে তাকালেন তরুণ দে।
জীবনে এত অসহায় আগে কখনও লাগেনি তরুণবাবুর। বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পারিবারিক চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেছেন। কিন্তু সেই হাসপাতালে যাওয়ার পথেই ভিআইপি রোডের যানজট। প্রতি বছরই পুজোয় শ্রীভূমির ভিড়ের কারণে ওই রাস্তায় গাড়ি নড়ার অবস্থা থাকে না। এমনি গাড়ি তো বটেই, এমনকি অ্যাম্বুল্যান্স, দমকল— কারওরই পরিত্রাণ নেই সেই যানজট থেকে।
বছরের এমনি দিনে কলকাতা-সহ দেশের প্রধান শহরগুলিতে যানজটের কারণে নষ্ট হওয়া সময় সংক্রান্ত একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা-রিপোর্ট আক্ষরিক অর্থেই চমকে দেওয়ার মতো। যেমন, ছ’টি মহাদেশের ৫৭টি দেশের ৪১৬টি শহরের যানজট নিয়ে করা একটি অগ্রণী আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের যানজট-দীর্ণ দেশগুলির মধ্যে ভারত অন্যতম। যানজটে ভোগা বিশ্বের প্রথম ২০টি শহরের মধ্যে চারটিই হল ভারতের— মুম্বই (দ্বিতীয় স্থানে), বেঙ্গালুরু (ষষ্ঠ স্থানে), দিল্লি (অষ্টম স্থানে) এবং পুণে (ষোড়শ স্থানে)। এই চার শহরে ‘কনজেশন লেভেল’ বা যানজটের শতকরা হার যথাক্রমে ৫৩, ৫১, ৪৭ এবং ৪২ শতাংশ।
ওই সমীক্ষক সংস্থার ২০১৯ সালের রিপোর্ট আবার জানাচ্ছে, শুধু যানজটের কারণে বছরে বেঙ্গালুরুর সময় নষ্ট হয় গড়ে ২৪৩ ঘণ্টা (১০ দিন ৩ ঘণ্টা)। অর্থাৎ, এক জন বেঙ্গালুরবাসী বছরের গড়ে ১০টা দিন শুধু যানজটেই কাটান! একই ভাবে যানজটের কারণে মুম্বইয়ের সময় নষ্টের হার বছরে ২০৯ ঘণ্টা, পুণের ১৯৩ ঘণ্টা এবং দিল্লির ১৯০ ঘণ্টা!
কলকাতার ক্ষেত্রে অবস্থাটা কেমন? অন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা জানাচ্ছে, যাতায়াতের ক্ষেত্রে যানজটের কারণে এ শহরে প্রতিদিন গড়ে দেড় ঘণ্টা বাড়তি সময় লাগে। এবং ব্যস্ত সময়ে গড়ে ১৪৯ শতাংশ বেশি সময় খরচ করতে হয়। যদিও অনেক ট্র্যাফিক বিশেষজ্ঞই একটি বিষয়ে একমত যে, শুধুমাত্র পুজোর ক’টা দিনের উপরে ভিত্তি করে সমীক্ষা চালালে দেখা যাবে, সময় নষ্টের তালিকায় বিশ্বে শীর্ষ সারিতে থাকবে কলকাতাই! এক ট্র্যাফিক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘কলকাতা পুলিশ ভাল ভাবে ভিড় সামলালেও শহরের পরিসর থেকে বেরোলেই চিত্রটা বদলে যায়। বিশেষত, শহরতলির ভিড় নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশের হাতে থাকে না। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ শ্রীভূমির মতো পুজো।’’
‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছনোর তাড়া রয়েছে, অথচ যানজটে পড়তে পারি’— এমন উদ্বেগ মনে কতটা চাপ ফেলে? মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলছেন, ‘‘পুজোকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের মধ্যে একটা উৎসাহ, উদ্দীপনা, ভাল থাকার ধারণা (সেন্স অব ওয়েল বিয়িং) কাজ করে। কিন্তু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সঙ্কটের কারণে সব পরিবার তো উৎসবে যোগ দিতে পারে না। সেই সঙ্কটের সঙ্গে যদি নির্দিষ্ট গন্তব্যে ঠিক সময়ে পৌঁছনোর পথে যানজটের বাধা যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে।’’
যানজটের কারণে হওয়া আর্থিক ক্ষতি নিয়ে কয়েক বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, শহরে দু’ঘণ্টার যানজটের কারণে প্রায় ৭৪ হাজার টাকা ক্ষতি হয়, বছরে ওই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২.৭ কোটি টাকা। সমীক্ষাটি করেছিলেন অপরাজিতা চক্রবর্তী ও সুদক্ষিণা গুপ্ত। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতির অধ্যাপক তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন অব আর্টস সুদক্ষিণাদেবী এ বিষয়ে জানাচ্ছেন, পুজোর সময়ে অফিস, স্কুল-সহ সমস্ত জায়গা বন্ধ থাকার কারণে আর্থিক ক্ষতি সে ভাবে হয় না। ব্যবসাও ভালই হয়। কিন্তু তাঁর সংযোজন, ‘‘ব্যবসায়িক ক্ষতি না হলেও পুজোর ভিড়ের কারণে চিকিৎসা সংক্রান্ত বা বিমান, ট্রেন ধরার ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা বা ক্ষতি হলে তা সমষ্টিগত সেই বাণিজ্যিক লাভের তুলনায় বেশি না কম, সেটা কস্ট-বেনিফিট পর্যালোচনা সাপেক্ষ।’’
যদিও তরুণবাবুর মতো ব্যক্তিগত সঙ্কটে ভোগা সাধারণ মানুষের কাছে সেই হিসেবনিকেশের খুব একটা দাম থাকে না। আজ, শুক্রবার বিজয়া দশমী। অ্যাম্বুল্যান্সে বসে উদ্বিগ্ন তরুণবাবু ভাবছিলেন, প্রতিমা নিরঞ্জন হবে। পুজো শেষ হবে। বাবাকে নিয়ে এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠারও হয়তো নিরসন হবে কখনও। কিন্তু যা থেকে যাবে তা হল, বছর বছর পুজোয় যানজটে আটকে থাকা, তাঁরই মতো ব্যক্তিগত সঙ্কটে ভোগা কোনও সাধারণ মানুষের অসহায়তা। থেকে যাবে ‘পুজো-শাসনে’ নষ্ট হওয়া অমূল্য, মহার্ঘ সময়, সময়-জীবন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy