Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Syndicate

সিন্ডিকেট-রাজ রুখবে কে? সরকারি জমিরও দর দু’কোটি

নির্মাণ ঘিরেই টাকা ওড়ে এখানে। অভিযোগ, সেই টাকার বখরা নিয়েই কসবা এলাকায় চলে শাসকদলের দুই পুরপ্রতিনিধির অনুগামীদের মধ্যে লড়াই! তাতে মাঝেমধ্যেই চলে বোমা, গুলি। খুনের মতো অপরাধও ঘটে যায়।

এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, টাকা তোলা ঘিরে অন্য সাম্রাজ্যের গল্প।

এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, টাকা তোলা ঘিরে অন্য সাম্রাজ্যের গল্প। — প্রতীকী চিত্র।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:১৯
Share: Save:

যে কোনও ধরনের নির্মাণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ!

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ঘিরে এমন সরকারি ব্যানার-হোর্ডিং চোখে পড়ে প্রায়ই। কারণ, আন্তর্জাতিক জলাভূমি সংরক্ষণ প্রকল্প রামসার সাইটের তালিকাভুক্ত এই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। কিন্তু নির্দেশই সার। অভিযোগ, দিন কয়েকেই হোর্ডিং খুলে শুরু হয় দেদার নির্মাণকাজ। নির্মাণ ঘিরেই টাকা ওড়ে এখানে। অভিযোগ, সেই টাকার বখরা নিয়েই কসবা এলাকায় চলে শাসকদলের দুই পুরপ্রতিনিধির অনুগামীদের মধ্যে লড়াই! তাতে মাঝেমধ্যেই চলে বোমা, গুলি। খুনের মতো অপরাধও ঘটে যায়। কিন্তু সব জেনেও পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে বলে অভিযোগ। শাসকদলের নেতারা দু’পক্ষকেই সতর্ক করা হয়েছে বলে দায়সারা মন্তব্য করলেও পরিস্থিতি বদলায় না। টাকার বখরা নিয়ে চলে হানাহানির সিন্ডিকেট-রাজ!

কসবার ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি সুশান্ত ঘোষকে খুনের চেষ্টার পরে ফের এ নিয়ে সরব স্থানীয়েরা। তাঁদের অভিযোগ, প্রায়ই ওই এলাকায় দু’গোষ্ঠীর গন্ডগোল হয়। কয়েক মাস আগেই পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, মুখ্যমন্ত্রীকে প্রতিক্রিয়া দিতে হয়। সেই সময়ে সুশান্ত পাশের ১০৭ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি লিপিকা মান্নার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন, ‘‘আগে কাউন্সিলর হয়েছে, তার পরে দল করেছে। আগে স্কোয়ার ফুট চিনেছে, তার পরে দল চিনেছে।’’ লিপিকা যদিও পাল্টা মন্তব্য করে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্ব সামনে আনেননি। তবে এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়, টাকা তোলা ঘিরে অন্য সাম্রাজ্যের গল্প। স্থানীয়দের দাবি, এর জেরেই হয়তো সুশান্তকে সরানোর পরিকল্পনা করেছিল একটি দল। অন্য দল টের পাওয়ার আগেই ঘটে গিয়েছে সবটা।

পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের খবর, কসবা, রাজডাঙা, ইন্দু পার্ক-সহ বিভিন্ন এলাকায় ছিল সুশান্তের একচ্ছত্র প্রভাব। কিন্তু শাসকদলের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র যত ভাগ হতে থাকে, ততই ওই এলাকায় অপর পক্ষের উত্থান শুরু হয়। সেই সূত্রে ১০৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সরতে হয় সুশান্তকে। ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপ্রতিনিধি হলেও ২০২১ সালের ভোটে সুশান্তকে সে ভাবে কসবায় প্রচার করতেই দেখা যায়নি। ওই এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, এর মধ্যেই শাসকদলের এক নেতার হাত ধরে পুর অন্দরে এবং কসবায় ক্ষমতা বাড়ে অন্য এক পুরপ্রতিনিধির। কিন্তু নিজের কেন্দ্র ছাড়লেও সুশান্ত জমি ছাড়েননি। খুনের চেষ্টার পরে তিনি বলেছেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবাশিস কুমার ১০৭ নম্বরের ব্যাপারে মাথা না ঘামাতে বলেছিলেন। কিন্তু আমার বাড়ি ১০৭ নম্বরে, আমার হাতে তৈরি এলাকা। এখানকার লোকজন নানা বিষয়ে আলোচনা করতে আসেন। বারণ করলেও আমাকে তো মানুষের কথা শুনতে হবেই।’’

অভিযোগ, মানুষের ‘কথা শোনা’র নামেই আসলে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় মেতে থাকেন শাসকদলের দুই পুরপ্রতিনিধি। শহরে এই এলাকাতেই গত ১০ বছরে সর্বাধিক পুকুর বুজিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি জমির হাতবদল এবং বিক্রির অভিযোগও সবচেয়ে বেশি এই দুই ওয়ার্ড ঘিরে। সূত্রের খবর, ১০৭ এবং ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডে ১৯০টিরও বেশি জমি রয়েছে, যা সরকারি হলেও বেআইনি ভাবে হাতবদল হয়েছে। এলাকার বাসিন্দা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক পুরপ্রতিনিধি-ঘনিষ্ঠের দাবি, ‘‘কসবায় কাঠাপিছু ৬০-৮০ লক্ষ টাকা দাম চলে। বাইপাসের কাছাকাছি হলে কাঠাপিছু জমির দাম দেড়-দু’কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সরকারি জমি, কারও থেকে বেচাকেনার কথাই নয়। অথচ কাঠাপিছু দেড়-দু’কোটি টাকা করে আয় হয়! এর ভাগ যে কত দূর পর্যন্ত পৌঁছয়, তা বলার নয়।’’

আর এক বাসিন্দা জানাচ্ছেন, ১০৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যেই রয়েছে গুলশন কলোনি, মার্টিনপাড়া। এক ঝলকে এই এলাকাগুলি যে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত, তা বোঝার উপায় নেই। দুই এলাকা থেকেই সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক দুষ্কৃতী ধরা পড়েছে পুলিশের জালে। ভিন্‌ রাজ্যের অপরাধীদের মুক্তাঞ্চল হিসাবে এই দুই এলাকাকে দেখা হয় পুলিশি মহলে। জঙ্গি ধরা পড়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে এখানে। রবিবার গুলশন কলোনিতে গিয়ে দেখা গেল, পর পর হয়েছে বেআইনি নির্মাণ। কোনওটি আবার পাশের বহুতলের গায়ে হেলে রয়েছে। কলোনির পাশেই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। অভিযোগ, এই জলাভূমির অনেকটাই বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। হাতবদল হয়ে সেই জমির অংশ বিক্রিও হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, যেখানে সরু গলিও বিক্রি হয়, সেখানে জমি বুজিয়ে বহুতল নির্মাণ ও তা বিক্রি কার্যত সাধারণ ব্যাপার। প্রশাসন কিছু বলে না? গুলশন কলোনির এক বৃদ্ধা বলেন, ‘‘প্রশাসনের মদতেই সমস্তটা হয়। নেতা-দাদা বা দিদির হাত মাথায় নিয়ে জমি বোজানো, ফ্ল্যাটের হাতবদল, দোকান ভাড়া দেওয়ার কাজ চলে। মন মতো বখরার হিসাব না মিললেই গন্ডগোল।’’ বৃদ্ধা আরও বলেন, ‘‘এখানে টাকা ওড়ে। টাকা ধরার চেষ্টাতেই এখানে লাশ পড়ে, লাশ ফেলার চেষ্টা হয়।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Syndicate Land Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy