Advertisement
E-Paper

ওরা ভাবত... মরার মতো দম আমার নেই, কৃত্তিকার সুইসাইড নোটের ‘ওরা’ কারা?

গোয়েন্দারা যে ফরেনসিক এবং মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিচ্ছেন, তাঁদের সবার কাছেই কৃত্তিকার মৃত্যুর ধরন এবং তার চিঠি— দুটোই বেশ বিরল।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সোমনাথ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ১৭:১১
Share
Save

আত্মহত্যাই করেছিল জিডি বিড়লা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা পাল। তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই নিশ্চিত হচ্ছে পুলিশ। আর তার তিন পাতার ‘সুইসাইড নোট’কে সমকালীন কিশোর মনস্তত্ত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে দেখছেন গোয়েন্দারা। বিশেষ একজন কাউকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটা লেখেনি কৃত্তিকা। কোনও অনুচ্ছেদ মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, কোনওটা বন্ধুদের। আবার কোথাও তার রাগ আর ব্যঙ্গের তির ছুটে গিয়েছে অজানা ‘ওদের’ লক্ষ্য করে।

“...অনেক দিন ধরে লড়ে যাচ্ছিলাম। ‘কেউ কেউ’ এটা দেখেছে। পাত্তাও দেয়নি। ‘ওরা’ ভাবতো ‘ওদের’ ঔদ্ধত্য দিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখবে। হা হা! যেন নিজেকে মেরে ফেলার মতো দম আমার নেই...”— লিখে গিয়েছে কৃত্তিকা। কৃত্তিকার এই ‘ওরা’টা কারা? ‘ওরা’ যে তার ঘনিষ্ঠ বা রোজকার মেলামেশার লোকজন তা না হয় ধরে নেওয়া যায়, কিন্তু কীসের দমনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে নিজেকে মারল সে?

গোয়েন্দারা যে ফরেনসিক এবং মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিচ্ছেন, তাঁদের সবার কাছেই কৃত্তিকার মৃত্যুর ধরন এবং তার চিঠি— দুটোই বেশ বিরল। আইনের ভাষায় খুন নয় বলে যদি প্রমাণও হয়, তবুও কৃত্তিকার মনের তল যতটা সম্ভব খুঁজে বের করতে গোয়েন্দাদের একটা অংশ খুবই আগ্রহী। তদন্তকারী এক পুলিশকর্তার কথায়, “এটা বেশ রেয়ার কেস। কৃত্তিকা যা লিখে গিয়েছে, তা শুধু একজনের মনের কথা নাও হতে পারে। সেই জন্যই এই চিঠির প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য, প্রতিটা অনুচ্ছেদকে তলিয়ে দেখা দরকার।” তদন্তকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিন পাতার চিঠিটা নিয়ে তারা যেমন মনস্তত্ত্ববিদদের মতামত নিচ্ছেন, তেমনই মতামত নেবেন হস্তলিপি বিশারদ বা গ্রাফোলজিস্টদের। চিঠির বক্তব্য ধরে তার মনের তল খোঁজার চেষ্টা যেমন হচ্ছে, তেমনই চিঠি লেখার সময় তার মানসিক অবস্থা আঁচ করার চেষ্টাও চলছে।

জিডি বিড়লা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী কৃত্তিকা পাল

গত শুক্রবার দক্ষিণ কলকাতার রানিকুঠিতে জি ডি বিড়লা স্কুলের শৌচাগারে যখন কৃত্তিকাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তার মুখ মোড়া ছিল প্লাস্টিকে। বাঁ হাতের কব্জির শিরা ছিল কাটা। পাশে পড়ে ছিল পেনসিল শার্পনারের ব্লেড এবং তিন পাতার চিঠি। শনিবার ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যায়, হাতের রক্তক্ষরণে নয়, তার মৃত্যু ঘটেছিল শ্বাসরোধ হয়েই। হাত থেকে যে পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, তাতে মৃত্যু সম্ভব নয় বলেও জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। একই সঙ্গে তাঁরা নিশ্চিত, কৃত্তিকা নিজেই ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কব্জি কেটেছিল। একই শার্পনারের হাল্কা কাটা দাগ আর রক্ত মিলেছে তার ডান হাতের আঙুলে। মুখের প্লাস্টিকে যে রক্তের দাগ ছিল তাও কৃত্তিকারই। তা ছাড়া ফরেনসিক পরীক্ষায় ওই প্লাস্টিকে কৃত্তিকা ছাড়া অন্য কোনও হাতের দাগের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অর্থাত্, কৃত্তিকা যে আত্মঘাতীই হয়েছে, এখনও পর্যন্ত তদন্তের প্রক্রিয়ায় পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত।

আরও পড়ুন:লভ ইউ কে, ডোন্ট ফরগেট মি... কৃত্তিকার ‘সুইসাইড নোটে’ কে এই ‘কে’? উত্তর খুঁজছে পুলিশ

তার মধ্যে যে আত্মহত্যার প্রবণতা দীর্ঘকালীন, তা নিজেই লিখে গিয়েছে কৃত্তিকা। চিঠিতে আছে, “ছোট্টবেলা থেকেই বরাবর আমার একটা মৃত্যুকামনা ছিল| ছোটবেলা মানে, যতদূর মনে পড়ে তখন বোধহয় আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি।” মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, “ক্লাস ওয়ানের স্মৃতি খুব একটা তাজা থাকে বলে আমার মনে হয় না। তবে ছাত্রীটির কথা যদি আক্ষরিক নাও ধরি, তা হলেও ধরে নেওয়া যায় অনেক আগে থেকে মৃত্যুর কথা ও ভেবেছে। খুব ছোটতে এটা ভাবার পিছনে মৃত্যু সম্পর্কে তীব্র কৌতুহল কাজ করতে পারে। কাজ করতে পারে জীবনযাপনের সঙ্গে কোনও ভাবেই মানাতে না পারার চাপ।”

কৃত্তিকার মৃত্যুতে জি ডি বিড়লা স্কুলের অভিভাবক ফোরামের পক্ষ থেকে আয়োজিত মৌন মিছিল

কৃত্তিকা লিখেছে, “যত বারই মেট্রো স্টেশনে গিয়েছি আমি ওই হলুদ লাইনটা ক্রস করে একটু ঝুঁকে পড়তাম আর ভাবতাম, ‘আহা, যেন পড়ে যাই, একবার যেন পড়ে যাই|’ এখন ভাবতে খুব অদ্ভুত লাগে যে এতটা এগিয়েও কোনও দিন ঝাঁপিয়ে পড়ি নি| হা হা!”

মোহিত রণদীপের মতে, “শৈশবে আত্মহত্যার প্রবণতা ওর মধ্যে থেকে থাকলেও, আমাদের বেশি ভাবতে হবে একটু বড় হয়ে ওঠার পর ওর মানসিক চাপের দিকটা নিয়ে। সেটা পরিবার বা পড়াশোনা থেকেই সবথেকে বেশি আসে। এটা কোনও একটা মেয়ের সমস্যা নয়, এটা এই সময়ের একটা সার্বিক সামাজিক সমস্যা।”

কৃত্তিকার বাবা-মা তাঁদের সন্তানকে হারিয়েছেন। ফিরে পাওয়ার কোনও উপায় নেই। কিন্তু কে বলতে পারে, সন্তানকে আর একটু মন দিয়ে দেখলে, আর একটু বোঝার চেষ্টা করলে, হয়ত এ ভাবে কৃত্তিকার জীবন শেষ হয়ে যেত না। মা আর বাবাকে কৃত্তিকা বলে গিয়েছে, “...আমি জানি তোমরা আমার জন্য অনেক কিছু করেছ| ঠিক আছে, অনেক কিছু| কিন্তু জানো তো, সব কিছুর সুফল পাওয়া যায় না এবং সবাই ফেরত দেয় না|” এ কি অভিমানের কথা? যন্ত্রণা ঢাকা কথা? কেউ এখন এর উত্তর দেওয়ার নেই। কিন্তু রবিবার সকালে, রানিকুঠিতে যখন কৃত্তিকার স্মরণে মৌনমিছিল করছিলেন জি ডি বিড়লা স্কুলের অভিভাবকরা, তখন তাঁদের মনেও বোধহয় একটা কথাই বাজছিল— কেন মরে গেল কৃত্তিকা? এটা জানা দরকার। জানা দরকার আমাদের বেঁচে থাকা সন্তানসন্ততিদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যই।

আরও পড়ুন:প্রত্যাশার পাথরেই যেন সব চাপা না পড়ে যায়

Krittika Paul suicide G.D Birla institution for girls suicide note

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।