ছবি, লেখালিখি, গান, নাটক বা খেলাধুলোর ঝলমলে উত্তাপ নিয়ে আমাদের কলকাতা। এরাই শহরের নিজস্ব টিপছাপ, রোজকার জীবনের উষ্ণতা। অতিমারি-আবহে প্রাণের সেই স্পন্দন ম্রিয়মাণ, শিল্প-সংস্কৃতির প্রবাহ খানিক ক্ষীণতোয়া। চিত্রকলার প্রত্যক্ষ পরিসর সঙ্কুচিত হয়ে আসায় গ্যালারির বদলে প্রদর্শনীর ঠিকানা হয়েছে আন্তর্জাল, ছবির সঙ্গে দর্শক বা রসজ্ঞের প্রত্যক্ষ সংযোগ হচ্ছে আলগোছ। এই সব প্রতিকূলতার মধ্যেও যখন খবর মেলে এই শহরেই চলছে যোগেন চৌধুরীর সাম্প্রতিকতম ছবির প্রদর্শনী যো ২০২১, তখন বলতেই হয়, এসো সুসংবাদ, এসো।
দক্ষিণ কলকাতার ‘দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস’-এ গত ২৯ অগস্ট শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। তবে তার নেপথ্যপট আলাদা করে বলার। সাধারণত কোনও শিল্পীর প্রদর্শনীকে ঘিরে ক্যাটালগ বা বই প্রকাশের রীতিই চালু, এ ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটা। শিল্পী যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার ফসল সাক্ষাৎকার/ যোগেন চৌধুরী বইটি প্রকাশ পেয়েছে ওই দিনেই। শিল্পীজীবনের যাত্রাপথ, চড়াই-উতরাই ধরা আছে অকপট ভাষ্যে। দেশের বাড়ি, কলকাতায় উদ্বাস্তু জীবন, শিল্পভূমি প্যারিস-বাস... আত্মজীবন খুলে গেছে প্রতি পরতে।
কী ভাবে হতে পারে এমন এক বইয়ের উদ্যাপন? শিল্পীর আঁকা ছবি দিয়েই। সে ভাবনাই রূপ পেয়েছে মোট ১০১ চিত্রকৃতি দিয়ে সাজানো এই প্রদর্শনীতে। পোস্টকার্ডের উপরে কালিকলম (ছবিতে তেমনই দু’টি), কাগজের উপর রঙিন প্যাস্টেল, সাদা কাগজে তুলির আশ্চর্য আঁচড়ে চিত্রপট আগলে রাখা অবয়ব, ক্রস হ্যাচ, ছাপাই ছবি কিংবা ব্রাউন পেপারে চারকোল-কাজ, যেমন করতেন ছবিজীবনের শুরুর দিনগুলোয়— প্রদর্শনীর আয়নায় এ যেন শিল্পীজীবনের নানান বাঁককে দেখা।
এ এক অভিনব ঘটনা, যেখানে গ্যালারির পরিসর অনুসারে শিল্পী বদলে নিচ্ছেন ছবির আকার। মাঝারি মাপের ছবির পাশাপাশি বেশ কিছু ছোট ছবি, দর্শক আর শিল্পের সম্পর্কে নৈকট্য আনে আরও। সিংহভাগ ছবিই গত দু’বছরে আঁকা, কিন্তু ছবির বিষয়, মাধ্যম ও
আকারের বিপুল বৈচিত্রে যেন এক রেট্রোস্পেক্টিভ প্রদর্শনী-আবহ। যোগেন চৌধুরীর ছবিতে বার বার উঠে আসে মুখের সারি— চেনা, আধো-চেনা, স্মৃতিসম্ভূত। সাম্প্রতিক কালে শিল্পীর এতগুলি নতুন কাজের একত্র সমাবেশ কলকাতা দেখেনি। প্রদর্শনী ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, মঙ্গলবার বাদে রোজ দুপুর আড়াইটে থেকে রাত সাড়ে ৮টা, কোভিডবিধি মেনে। দেখা যাবে দেবভাষা-র ওয়েবসাইটেও।
শুধু স্বাতীলেখা
সোফোক্লেসের আন্তিগোনে তিনি। ইউরিপিদিসের ইফিজেনিয়া, ব্রেশটের গ্রুশা, আর্থার মিলারের বিয়াত্রিচ বা লিন্ডা, বার্গম্যানের নোরা-ও। আবার ফুটবল নাটকে মা, পাতা ঝরে যায় বা অজ্ঞাতবাস-এর বয়স্কা মহিলাটি, শানু রায়চৌধুরী-র একক বা নাচনী-র মুখ্য চরিত্র। এ তো অভিনয়-সত্তা। বাংলা নাট্যমঞ্চের জন্য রূপান্তর করেছেন কুরোসাওয়ার রশোমন থেকে বিক্রম সাহনী, নাট্যরূপ দিয়েছেন লীলা মজুমদারের লেখাকে, ছোটদের জন্য লিখেছেন নাট্যত্রয়ী; সঙ্গীত পরিচালনা, পোশাক পরিকল্পনা, নির্দেশনার কথা নাহয় ছেড়েই দেওয়া গেল। েদশ-বিদেশের আমন্ত্রণ, সম্মাননা, পুরস্কার— সব পেরিয়ে তিনি শুধু ‘নান্দীকার’-এরই নন, নাট্যপ্রেমী প্রতিটি মানুষের স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত (ছবিতে)। তাঁর স্মৃতিতে আগামী কাল, ১২ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় অ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে একত্র হবেন ‘স্বাতীদির নাট্য-সাথীরা’, আবৃত্তি, গান, ছবি, কথায়। বিধি মেনে স্বাগত সবাই।
বিচিত্র পথে
অবনীন্দ্রনাথের শিল্প ও সাহিত্যের ভাষা ক্রমপ্রসারিত করেছিল শিল্পদিগন্ত, তা নিয়েই গত ২ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাল-আলোচনা হল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ়-এর উদ্যোগে। শিল্পভাবনার ভারতীয়তাকে আন্তর্জাতিকতায় স্থাপিত করেন তিনি, নিজ চিত্রভাষাকে নানা শিল্পরীতির যোগে করে তোলেন বিচিত্র। অন্য দিকে তাঁর গদ্যরীতি যেন স্পর্শ করে বাংলা কবিতার আধুনিকতাকে। সূত্রগুলি উঠে এল সুশান্ত দত্তগুপ্ত, নানক গঙ্গোপাধ্যায়, সুমন গুণের আলোচনায়। ধ্রুপদী রীতিতে লৌকিক ভাষা মিশিয়ে খুদ্দুর যাত্রা-য় নতুন শিল্পরীতি এনেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, ধরিয়ে দিলেন সমন্বয়কারী শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউটিউবে ধরা আছে অনুষ্ঠানটি।
নগর-পাঠ
প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘মেট্রোপলিস’ শব্দের অর্থ ‘মাতৃ শহর’— অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বাণিজ্যের কেন্দ্র, ছোট ছোট শহর থেকে বহু মানুষ যেখানে ভিড় জমান। কয়েক শতক পার করা কলকাতাও তেমনই এক শহর, বহু বিচিত্রের মিলনে সমৃদ্ধ। বিবিধতার এই কেন্দ্রে পরিযাণ, মিশ্রণ ও পরিচিতির গল্প নিয়ে আগামী ১৭, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জালে আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছে ‘বিচিত্র পাঠশালা’। পরিযায়ীদের এই শহরটি কী রকম, মানুষ কেন কলকাতামুখী আর সেখানে সংঘাতের চরিত্রই বা কেমন, সে কথা সাহিত্য-সিনেমায় ধরা পড়ল কি না— নানা প্রসঙ্গ উঠে আসবে বিশিষ্টজনের কথায়। ছাত্রছাত্রীদের ফিল্ম তৈরি, ছবি তোলা শেখানোর পর এ বার শহর চেনাবে অন্য রকম এই পাঠশালা।
নাটক নিয়ে
মহানগরের বাইরে, নিমতা থেকে সুন্দরবন, বনগাঁ-সহ বাংলা জুড়ে নাট্যচর্চায় মগ্ন নারী নির্দেশক ও কর্মীদের কৃতিকে তুলে ধরতে পাঁচ দিন ব্যাপী ‘নারী নাট্য উৎসব ২০২১’ আয়োজন করছে মানিকতলার নাট্যদল ‘দলছুট’। ১৩ সেপ্টেম্বর দলের জন্মদিনও, সে কথা মাথায় রেখেও এই উৎসব। মিনার্ভা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রে শুরু আগামী কাল, ১২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায়, বারোটি নাটক, চলবে ১৬ পর্যন্ত। অন্য দিকে, সম্প্রতি প্রয়াত বিশিষ্ট শব্দগ্রাহক ও ধ্বনি-প্রক্ষেপক নগেন্দ্রনাথ দত্তকে স্মরণ করবেন থিয়েটারের আত্মজনেরা, আজ সন্ধে ৬টায়, ‘শৌভনিক’ দলের উদ্যোগে, মুক্ত অঙ্গন রঙ্গালয়ে। আর আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর শিশির মঞ্চে ‘মূকাভিনয় প্রতিভার অন্বেষণে’ একটি সন্ধ্যা যাপন করবে ‘মডার্ন মাইম সেন্টার’।
সুরপ্রতিমা
মায়ার খেলা, শাপমোচন, বাল্মীকি-প্রতিভা, চিত্রাঙ্গদা— সবেতেই সপ্রাণ তাঁর কণ্ঠ। তাঁর সুরেলা অথচ বলিষ্ঠ গায়নে লোকপ্রিয় হয়েছে আমার সকল রসের ধারা, যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, আমার মনের কোণের বাইরে-র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত। প্রতিমা মুখোপাধ্যায়ের গানের পাঠ ‘বৈতানিক’-এ প্রসাদ সেন ও ‘গীতবিতান’-এ নীহারবিন্দু সেনের কাছে, পরে দেবব্রত বিশ্বাসের কাছেও। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী তিনি, কংগ্রেসের অধিবেশনে অরূপরতন নাটকে মুগ্ধ করেছিলেন গান-অভিনয়ে, ভারতীয় শিল্পীদলের সঙ্গে সফরে রবীন্দ্রগানে মাতিয়েছেন রাশিয়া। ১৯৬১-তে প্রথম রেকর্ড, কেন যে মন ভোলে আর মুখপানে চেয়ে দেখি। রেডিয়োয় গেয়েছেন পল্লিগীতি, ৪টি বাংলা আধুনিক রেকর্ড করেছেন। কলকাতার দু’টি স্কুলে গান শিখিয়েছেন সুদীর্ঘ কাল, বাড়িতেও, কয়েক বছর আগে অবধি। আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর ৮৮ পূর্ণ হত তাঁর, চলে গেলেন তার আগেই, গত ১৭ অগস্ট।
রোমন্থনপুর
পোস্টকার্ডে চিঠি লেখা পরের কথা, শেষ কে কবে পোস্টকার্ড চোখে দেখেছেন? পুরনো অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে বা যাওয়ার মুখে, পোস্টকার্ডের গন্ধমাখা নিজের ছোটবেলাটাকেই এই সময়ে একটু ফিরে দেখলে কেমন হয়? সে কাজটাই করেছে ‘হার্টিস্টিক’— অভিনব প্রিন্টেড পোস্টকার্ড বানিয়ে। ‘ডাক টেলস’ নামের এই সিরিজ়ে আছে একগুচ্ছ ছাপা পোস্টকার্ড, প্রথমটির নাম-ঠিকানার জায়গায় লেখা— ‘ছোটবেলা, ১, ডাউন মেমোরী লেন, গ্রাম+পো: ফিরেদেখা, জেলা: রোমন্থনপুর’। ‘প্রিয় ছোটবেলা’-কে চিঠি লিখেছে ‘আমি’। প্রতিটি পোস্টকার্ডের গায়ে ছবি— তোরঙ্গ, পুরনো ক্যামেরা, পুতুলের বিয়ে, এক্কাদোক্কা বা মার্বেল খেলা, ফোর্ড-অ্যাম্বাসাডর গাড়ি, রকের আড্ডা, দোয়াত আর পালকের কলম, স্লেট-খড়ি, টাইপরাইটার। পোস্টকার্ডের গায়ে আঁকিবুঁকিতে হাওড়া ব্রিজ, ঠাকুরদালান, গলি ক্রিকেট আর কফি হাউসে (নীচে ছবিতে) উঁকি দিয়ে যায় আদি, অকৃত্রিম কলকাতাও। পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়া না হোক, অন্তত তাদের মনে রাখা— এটুকুই উদ্দেশ্য এই শিল্পবস্তুগুলির। কেবলই অতীতবিলাস নয়, আছে ইতিহাসের স্বাদও— ‘ইস্ট ইন্ডিয়া পোস্ট কার্ড’ বা ১৯৮৯ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ফিলাটেলিক এগজ়িবিশন’-এর ডাক-ছাপ।
লক্ষ্মী যখন
‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর স্বদেশি জাগরণের অন্তঃস্রোতে সরলা দেবী চৌধুরানী মিশিয়ে দিয়েছিলেন সে কালের অবগুণ্ঠিতা ভারতীয় নারীর স্বনির্ভরতার বীজমন্ত্র। ফলে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ (১৯০৪) কেবল বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা ‘শুধু মেয়েদের জন্য একটি স্বদেশী বস্ত্রের ও দ্রব্যের’ সমষ্টিই হয়ে থাকেনি, সূচনাবর্ষেই সে ডাক পেয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের বম্বে অধিবেশনে স্বদেশি প্রদর্শশালার মহিলা বিভাগের অগ্রণী দায়িত্ব পালনের। উচ্চপ্রশংসিত সেই প্রদর্শনীর স্বীকৃতির স্মারক একটি সুদৃশ্য মেডেল (ছবিতে) ব্রোচ করে পরতেন সরলা দেবী চৌধুরানী (১৮৭২-১৯৪৫)। ৯ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ শুরু হল। অহর্নিশ পত্রিকা তাদের রজত জয়ন্তী বর্ষ পালনের অঙ্গ হিসেবে এই মহীয়সীকে স্মরণ করবে আজ, সন্ধে ৬টায়, তাদের ইউটিউব চ্যানেলে। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও সরলা দেবীর স্বদেশ ভাবনা’ নিয়ে বলবেন শুভাশিস চক্রবর্তী।
সারস্বত
এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস, কবিতায় লিখেছিলেন টি এস এলিয়ট। আর বাঙালি পাঠক বলবেন, সেপ্টেম্বর হল আনন্দপুলকের মাস। কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের জন্মদিন ধরে একটা ক্যালেন্ডার তৈরি করা গেলে বোঝা যেত, বাঘা বাঘা কলমের আলোয় উজল হয়ে আছে মাসটা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিমল কর, সন্তোষকুমার ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কত জন! আর আছেন তিনি— বিদ্যাসাগর নাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy