ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন তখন পাকাপোক্ত। কিন্তু উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই এশিয়াতে রাশিয়ার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা তৈরি করল নতুন সমস্যা। অবস্থা আরও ঘোরালো ওঠে রঞ্জিত সিংহ পেশোয়ার-সহ বেশ কিছু এলাকা জমি দখল করায়। আফগান আমির দোস্ত মোহম্মদ ব্রিটিশের সাহায্য চাইলেন। কিন্তু শক্তিশালী শিখদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চাইছিল না কোম্পানি, বিশেষত লর্ড অকল্যান্ড। তখন কোম্পানিকে কিছুটা ভয় দেখাতেই রাশিয়ার দূতকে সভায় আহ্বান করলেন দোস্ত মোহাম্মদ। রাশিয়ার ভারত আক্রমণের ভয় ব্রিটিশদের আরও দৃঢ় হল রাশিয়ার সঙ্গে আমিরের আলোচনা ভেঙে পড়ায় আর রাশিয়ার সমর্থনে কাজার জনজাতিদের হেরাত শহর অবরোধে। অকল্যান্ড ভাবলেন, আর দেরি নয়। জনজাতিদের তাড়িয়ে, আমিরকে সরিয়ে পছন্দের লোক মসনদে বসিয়ে আফগান সীমান্ত নিষ্কণ্টক করা দরকার। ১৮৩৮-এর ডিসেম্বরে জন কিন-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী আফগানিস্তান অভিযানে চলল। তত দিনে জনজাতিরা অবরোধ তুলে নিয়েছেন, জ়ার প্রথম নিকোলাসের দূতও প্রত্যাহৃত আফগানিস্তান থেকে।
তবু হাল্লাকে যুদ্ধে যেতেই হয়। দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এক মসৃণ এক যুদ্ধাভিযানের কল্পনা করে সাহেবরা চললেন কাবুল দখল করতে। লটবহরের মধ্যে যুদ্ধের সরঞ্জামের সমান গুরুত্ব পেল সিগারেট আর শিকারের সরঞ্জাম। আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের খেসারতে প্রায় পুরো সৈন্যদলটাই এই যুদ্ধে খোয়াল ব্রিটিশরা। হাতেগোনা জনকয় মাত্র ফিরতে পেরেছিলেন।
প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের শিক্ষা থেকে ব্রিটিশরা বুঝেছিল, ভারতে শাসন কায়েম রাখতে হলে বাড়াতে হবে গোলাবারুদের জোগান। তাই তৎকালীন বেঙ্গল আর্টিলারির সদর দফতর দমদমে এ দেশে ব্রিটিশদের প্রথম গোলাবারুদ তৈরির কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার আগেই ১৮৪২-এ তৈরি হয় আফগান যুদ্ধে হারানো সঙ্গীদের স্মৃতিস্তম্ভ, আজও যা দাঁড়িয়ে অকল্যান্ডের ভুলের সাক্ষী হয়ে। অবশ্য এ গল্পে সে যুদ্ধের হাজার হাজার অসামরিক লোকজন— এদেশীয় ধোপা, নাপিত, মোটবাহক, রাঁধুনি, সাফাইকর্মীর উল্লেখ নেই, যাঁরা এই অভিযানের অংশ হয়ে আফগানিস্তানের মাটিতে হারিয়ে গেছেন। শহর কলকাতার ঐতিহ্য-তালিকায় বিখ্যাত ‘শহিদ মিনার’-এর তুলনায় প্রায় ভুলে-যাওয়া এই স্মৃতিসৌধ আজও আফগানিস্তান আর কলকাতার মধ্যে এক যোগসূত্র। কেউ মনে রাখুন আর না-ই রাখুন, আজও প্রতি বার কাবুলের বাতাসে বারুদের গন্ধ আর মৃত্যুর হাহাকার ছড়িয়ে পড়লেই সেই ঘটনার কারণ সন্ধানে আমাদের ফিরে যেতেই হয় এই দীর্ঘ অন্ধকারের শুরু হওয়ার স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দমদমের এই একক, একাকী সৌধের কাছে। ছবিতে ব্রিটিশ শিল্পীর আঁকা সেই সৌধ ও তার বর্তমান রূপ, পাশাপাশি।
তন্নিষ্ঠা
আরণ্যক-এর ফরাসি অনুবাদের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সাহিত্য অনুবাদ পুরস্কার পাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ফরাসি অনুবাদক ফ্রাঁস মঁতেরু ভট্টাচার্য (ছবিতে)। বঙ্গপ্রকৃতির স্নেহস্পর্শের কাহিনিতে মুগ্ধ ফরাসি পাঠক। ফ্রাঁস পথের পাঁচালী-রও ফরাসি অনুবাদক। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইমেরিটাস প্রফেসর ছিলেন ফ্রান্সের প্রাচ্যভাষা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট। অনুবাদ করেছেন অন্নদামঙ্গল, ফরাসিতে চণ্ডীমঙ্গল-ও। এ ছাড়াও কপালকুণ্ডলা, আনন্দমঠ, যোগাযোগ, নষ্টনীড়-এর অনুবাদক তিনি— তারাশঙ্কর, জীবনানন্দেরও। লিখেছেন বিদ্যাসাগরের জীবনী, উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের চিন্তার ইতিহাস। ২০১২ সালে বাংলা সাহিত্যের এই তন্নিষ্ঠা সেবিকাকে সাম্মানিক ডি লিট-এ ভূষিত করেছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
অন্য চোখে
আমেরিকানদের রসেন্দ্রিয়ে পথের পাঁচালী-র আকর্ষণ কতখানি? সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ় বিভাগের অনলাইন সেমিনার ও বক্তৃতামালার দ্বিতীয় পর্বে সেই আলোচনাই হল গত ৮ অক্টোবর, সন্ধেয়। ছিলেন ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ডাডলি অ্যান্ড্রু ও ট্রিনিটি কলেজ, কানেক্টিকাট-এর অধ্যাপক প্রকাশ ইয়ংগার। পথের পাঁচালী এবং তার নির্মাতার সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে প্রসারিত আর্ট সিনেমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিত্ব, শৈলী ইত্যাদির সম্পর্কের ইতিহাস শোনালেন অ্যান্ড্রু। বড় জায়গা নিয়ে ছিল তাত্ত্বিক আঁদ্রে বাজ়াঁ, ফ্রান্সেস ফ্ল্যাহার্টি, পরিচালক জঁ রেনোয়া-র দ্য সাদার্নার ছবির কথা। নাট্যশাস্ত্র ও অভিনবগুপ্তের রসতত্ত্বের নিরিখে ছবিটির আলোচনা করলেন প্রকাশ। ওয়েবিনারটি শোনা যাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ইউটিউব চ্যানেলে।
নিভৃতচারী
সত্যজিৎ রায়ের সমবয়সি তিনি। ২ অক্টোবর পেরিয়ে গেল সঙ্গীতশিল্পী শিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৯২১-১৯৯৩) জন্মশতবর্ষ। সঙ্গীতে প্রাথমিক শিক্ষা ‘রানাঘাট ঘরানা’র প্রাণপুরুষ কর্তাদাদু নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মা ও দিদির কাছে। পরে রানাঘাটের নগেন্দ্রনাথ দত্ত, মুর্শিদাবাদের কাদের বক্স ও গৌরীপুরের বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তালিম, রামপুর ও ভাতখণ্ডে রীতিপদ্ধতির অনুশীলন, খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, টপ্পা, পুরাতনী, আগমনী-বিজয়া-শ্যামাসঙ্গীতে খ্যাতি। গড়েছিলেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘চণ্ডীমণ্ডপ’, তাঁর তৈরি ‘নগেন্দ্র শিবকুমার সংগীত পরিষদ’ আজও বহতা। অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের অগ্রজ, চারুলতা ও অমরগীতি ছবির এই নেপথ্যগায়কের ছিল অচলিত রাগরাগিণীর বিপুল সংগ্রহ। হরপ্পা পত্রিকা সম্প্রতি প্রকাশ করল শংকরনাথ ঘোষের লিখনে, সোমনাথ ঘোষের সুচারু শিল্প নির্দেশনায় বৈদ্যুতিন পুস্তিকা— শতবর্ষে শিবকুমার। অনন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য, শিবকুমারের লেখা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর গান নিবন্ধটিও অমূল্য প্রাপ্তি।
মানুষী কথা
‘এটা কোরো না’, ‘সেটা করতে নেই’, মেয়েদের জন্য যেন নিয়মই আলাদা। সমাজে তো বটেই, গড়পড়তা পরিবারে এক সঙ্গে বেড়ে ওঠা ভাই আর বোনের মধ্যে কার জন্য আদরের বেশির ভাগটা বরাদ্দ, কারই বা পুষ্টি-চিকিৎসা-পড়াশোনায় ঘাটতি পড়ে, সবাই জানে। কোভিড টিকাতেও পশ্চিমবঙ্গে মেয়েরা বহু পিছিয়ে। বঞ্চনার এমনই সব সত্য উঠে এসেছে মানুষী কথা (সম্পা: প্রজ্ঞাপারমিতা দত্ত রায়চৌধুরী) পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। সত্যজিতের ছবির মুক্তিকামী নারী, দেশের প্রথম মহিলা আইনজীবী কর্নেলিয়া সোরাবজি থেকে স্বল্প পরিচিত সমাজকর্মী অনুশ্রী বিশ্বাস— মেয়েদের জীবনজয়ের পথের কাহিনি উঠে এসেছে প্রবন্ধে, গল্পেও।
প্রাসাদনগরী
কলকাতার গর্ব তার প্রাসাদোপম বাড়িরা। আঠেরো শতকে গড়ে ওঠা অট্টালিকাগুলোয় স্পষ্ট ইউরোপিয়ান ছাঁচ, গথিক বা ভিক্টোরিয়ান আদল। কোনওটির জ্যামিতিতে ইসলামিক মিনারের ছায়া, অপেরা হাউসের ধাঁচে ভিতর-নকশা কোথাও (ছবিতে)। শুধু শাসকগোষ্ঠীই নয়, নব্য ধনী বা বঙ্গীয় বাবুসমাজের বাড়ির বাহারও দেখার মতো। সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে চক মেলানো উঠোন, মর্মরমেঝের বৈভব, বাগানের মূর্তির বিভঙ্গ, গোলবারান্দার জাফরি। এই সব হর্ম্যের অন্তরসম্পদ অদেখা অনেকেরই। সেই দুনিয়াই ধরা আছে ক্যালকাটা স্টেটলি হোমস অ্যান্ড প্যালেসেস বইটিতে। আলোকচিত্রী অনির্বাণ মিত্র দশ বছর ধরে ৪০টি বাড়ির অন্দরমহলের নানা মুহূর্ত লেন্সবন্দি করেছেন। সাড়ে তিনশোরও বেশি পাতা জুড়ে জেগে খিলান বেয়ে নেমে আসা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিকেল, লোহার গ্রিলে লেগে থাকা শীতের সকাল। কলকাতার এই রহস্যসম্পদের ছবি-আলেখ্যটিতে কথা সাজিয়েছেন বইটির প্রকাশক, ইজ়েডসিসি-র ডিরেক্টর গৌরী বসু।
জীবনছবি
“বামপন্থী ঘরানার মানুষ ছিলেন, সামাজিক ন্যায়ে বিশ্বাস করতেন,... কিন্তু কোনোদিনই তাঁকে কোনো দলের কাছে চিত্ত বা বিবেক বন্ধক রাখতে দেখিনি।” শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে লিখেছেন দীপেশ চক্রবর্তী, ‘নান্দীপট’-এর বার্ষিক নাট্যপত্রে (তৃতীয় বর্ষ, ২০২১, আমন্ত্রিত সম্পাদক ভবেশ দাশ)। লিখেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শাঁওলী মিত্র-সহ বিশিষ্টজন। ‘শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে বৈঠক’-এ তাঁর সঙ্গে দেবাশিস মজুমদারের কথায় উঠে এসেছে জরুরি বহু প্রসঙ্গ। আছে কবির অনূদিত ভারাভারা রাওয়ের কবিতা, তাঁরই হস্তাক্ষরে। এ ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে অশোক মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের ‘সত্যজিৎ রায়: নাট্য প্রসঙ্গ’, অবন ঠাকুরের খুদ্দুর-যাত্রা নিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা।
শিল্পদর্শন
‘উদ্ভাস’ প্রকাশ করেছে শুভেন্দু দাশগুপ্তের লেখা ডিজিটাল-বই জনযুদ্ধে সোমনাথ হোর। ছোট ছোট পরিচ্ছেদে, বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে সাজানো, শুরুতে আছে জনযুদ্ধ পত্রিকায় শিল্পী সোমনাথ হোরের ছবি সংযুক্তির পটভূমিকা। উঠে এসেছে তাঁর রাজনীতিভূমি চট্টগ্রাম, দীক্ষাগুরু চিত্তপ্রসাদ, আর্ট স্কুল পর্ব ও কমিউনিস্ট পার্টির ‘হোলটাইমার’ হয়ে-ওঠার কথা। ১৯৪৪-১৯৪৫ কালপর্বে জনযুদ্ধ পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর আঁকা ছবি (সঙ্গের ছবিতে একটি)। পোস্টার, কার্টুন, পোর্ট্রেট, ছাপছবি, রোজনামচা, মন্বন্তরের নথিচিত্রে শিল্পীর শিল্পপথ সূত্রানুসারে নির্মাণ করেছেন লেখক, শতবর্ষে সোমনাথ হোরের (১৯২১- ২০০৬) রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শিল্প দর্শনের অনন্য আলেখ্য। ওয়েবসাইটে (উদ্ভাস ডট ইন) এমনই আরও সম্ভার।
পান্না-ঝরা
সভা, পুজো প্যান্ডেল, বিয়ে বা শ্রাদ্ধবাড়ি— শব্দপ্রক্ষেপকের গোড়ার পছন্দ কী? কিশোরকুমার, এবং কমলাকান্ত-রামপ্রসাদ-নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত। কে গাইবেন? কেন, পান্নালাল! পপ-র্যাপ-রিমিক্স-রিমেক আসে যায়, পান্নালাল ভট্টাচার্য বঙ্গমননের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। রেকর্ড ডাইনোসর, ক্যাসেট অতীত, সিডিরও যাচ্ছি-যাইয়ের যুগে চাঁদনি-এসপ্লানেড-রাসবিহারীতে আজও বিকোয় পান্না-ঝরা কণ্ঠ। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস-এর গলিতেও বাজে ‘মায়ের পায়ের জবা’, ‘আমি সব ছেড়ে মা’, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে’। গ্রামোফোন কোম্পানির স্বর্ণকালের প্রধান বাবুল রহমান অকুণ্ঠ, ওই গলার জোরেই কোম্পানির রমরমা ছিল দীর্ঘ কাল, পান্নালালের রেকর্ডের বিক্রিবাটা ছিল আকাশছোঁয়া। মৃত্যুর তিন যুগ পরেও হৃদি-আসনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy