কলকাতা শহরের বুকে যিনি বিদেশি গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াতেন, তিনি রাজপুরে থাকার সময় একটি রিক্সা কিনে ফেললেন। রিক্সার পেছনদিকে লেখা থাকত H.S.D, রিক্সাওয়ালার uniform বানিয়ে দিয়েছিলেনযার বুকপকেটে H.S.D. শোভা পেত।... তারপর চলে গেলেন শান্তিনিকেতন। পারুলডাঙা গ্রামে জীবন দলুইয়ের মাটির বাড়িতে থাকার সময় জীবনের ছেলেদের ও গ্রামের অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতেন। হলিউডের সুটেড বুটেড বাবার পরনে তখন লুঙ্গি ও গেরুয়া ফতুয়া।”— রাজা দাশগুপ্ত লিখেছেন ওঁর বাবা হরিসাধন দাশগুপ্ত সম্পর্কে। গত ১৪ এপ্রিল শতবর্ষ পূর্ণ করলেন ‘H.S.D.’, বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী মানুষটি।
নন্দন-৩’এ ওঁর জন্মদিনে, নববর্ষের বিকেলে এসেছিলেন যে আত্মজন, তাঁদের কাছে হরিসাধন দাশগুপ্ত হরিদা, হরিকাকা, হরিদাদু। ওঁকে কাছ থেকে দেখার, আপন সম্বোধনের মানুষও ক্রমে কমে যাচ্ছে এ শহরে, সে জন্যই ওঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে এই সময়কে জানানোর প্রয়োজন আরও। সেই ১৯৪০-এর দশকে যে মানুষটি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেছেন সিনেম্যাটোগ্রাফি, হলিউডে শিক্ষানবিশি করেছেন আরভিং পিচেল-এর তত্ত্বাবধানে, দেশে ফিরে সহকারী জঁ রেনোয়া-র, পরবর্তী কালে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন ভারতীয় তথ্যচিত্রকে, তাঁকে না জানাটা অন্যায়। স্মৃতিচারণায় বার বার উঠে এল হরিসাধনের করা কোনার্ক, পাঁচথুপী, মালাবার স্টোরি, স্টোরি অব স্টিল ইত্যাদি তথ্যচিত্রের কথা, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ওঁর ছবিগুলি দেখতে না-পাওয়ার আক্ষেপ।
তাঁর ‘মেন্টর’ হরিসাধন প্রসঙ্গে গৌতম ঘোষ বললেন ওঁর লেখাপড়া, চলচ্চিত্র-ভাবনা, দিলদরিয়া মেজাজ আর রসবোধের কথা, ওঁর সঙ্গে শুটিংয়ের গল্প। হরিসাধনের কাহিনিচিত্র একই অঙ্গে এত রূপ-এর ‘হাসি’, মাধবী মুখোপাধ্যায় চেনালেন ওঁর শুটিংয়ের শাড়ি-জামা-গয়নার নির্বাচন থেকে সেটে সুদৃশ্য চায়ের মগ থেকে লাঞ্চের টেবিলে ওঁর রুচিসৌকর্যকে। অপর্ণা সেনের স্মৃতিমন্থনেও ৬ নম্বর সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে ওঁর অবারিতদ্বার বাড়ির আড্ডার কথা, কলকাতার বিখ্যাত ‘বাড়ির আড্ডা’র ইতিহাসে যার কথা বলা হয় না বড় একটা। সোহাগ সেন, অশোক বিশ্বনাথন, রাজু রামন, রজত দাশগুপ্ত, বিশ্বপ্রসূন চট্টোপাধ্যায়দের বয়ানে যে মানুষটি ফুটে উঠলেন তিনি সিনেমায় নিবেদিতপ্রাণ, আবার তার বাইরে নিজের শর্তে জীবন খুঁজে নেওয়া এক মানুষ। দীর্ঘ দিনের সহকারী-সঙ্গী অরুণ রায় বললেন ওঁর ছবি ও লেখার সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও প্রকাশের গুরুত্ব সম্পর্কে। আশার কথা, নববর্ষে প্রকাশিত হয়েছে ওঁর চলচ্চিত্রযাপন (প্রকা: সপ্তর্ষি) বইটির নব সংস্করণ। এ দিনের অনুষ্ঠান সযত্নে বেঁধেছিলেন চৈতালি দাশগুপ্ত, ছিলেন রাজা দাশগুপ্ত আর বিরসা ও ঋভু, হরিসাধনের উত্তরাধিকার। ছবি দু’টি ওঁদের সৌজন্যে পাওয়া।
নতুন ভাবনা
নন্দন-রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে ঢোকার মুখে রাস্তায় ক্যালেন্ডার হাতে দাঁড়িয়ে ওঁরা, অল্পবয়সি ক’জন। কী ব্যাপার? নতুন বাংলা বছরের ক্যালেন্ডার করেছি আমরা, নিন একটা। আমরা মানে, ‘আনুষঙ্গিক’। ছোট্ট একটি দল: শিল্পচর্চায় রত, দশের সেবায়ও। এর আগেও নববর্ষের ক্যালেন্ডার করেছেন ওঁরা, ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ক্যালেন্ডার সাজিয়েছেন বাংলা সিনেমাকে ঘিরে ছবি ও কবিতায়, নাম ‘Cনেস্কোপ’। সোনার কেল্লা, মেঘে ঢাকা তারা (ছবি), পথের পাঁচালী, একদিন প্রতিদিন, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর খেলা— এই ছয় বাংলা চলচ্চিত্র উঠে এসেছে ক্যালেন্ডারের ছ’টি পাতায়: কখনও সৃষ্টি, কখনও বা স্রষ্টাকে মনে করিয়ে। সিনেমাগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতিকে যোগ্য সঙ্গত করেছে ওঁদের কবিতা, যেমন একদিন প্রতিদিন প্রসঙ্গে: “আমরা আলোর কথা, ফুরিয়ে আসা বিকেলে বলি/ আর অপচয়ের কথা, সম্ভাবনাময় সকালে।” নানা শিল্পমাধ্যমকে মেলানো, এই সময়ের নবীনদের এই ভাবনা ভাবাবে অন্যদেরও, হোক না ক্যালেন্ডারে।
বই নিয়ে
বই পড়ার অধিকার আছে সকলের, কিন্তু বই প্রকাশের অধিকার? বই নিয়ে কথাবার্তায় বই প্রকাশের নানা নীতি ও প্রয়োগের বাগড়া নিয়ে কথা হয় কম, লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে প্রকৃত সেতু তৈরি হয় না, আঁধারে থাকেন পাঠকও। অথচ এই সব, এবং আরও অনেক প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বই নির্মাণের সঙ্গে, যাদের যথার্থ উত্তর বিনা বই-আস্বাদন বা পাঠ-অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ। আগামী ২৩ এপ্রিল ‘বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস’, এই আবহেই হওয়া দরকার এ সব কাজের কথা। ‘কলেজ স্ট্রিট ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজন করেছে আলোচনা: বই পড়া ও বই প্রকাশের অধিকার নিয়ে বলবেন পবিত্র সরকার অনিল আচার্য ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী দেবব্রত মান্না। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায়, মহাবোধি সোসাইটি সভাকক্ষে।
দিশারি
গত দুই দশক নাচের মতো শিল্পমাধ্যমের আশ্রয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন কলকাতার সংশোধনাগারগুলিতে। সমাজের চোখে যারা অপরাধী, আইনের চোখে দণ্ডিত, তাদের মধ্যে জাগিয়েছেন শিল্প-অভিজ্ঞতা, তারই সূত্রে মানবিকতার বোধ— দরদ, ভালবাসার অনুভব। প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার ও আলিপুর নারী সংশোধনাগারে অলকানন্দা রায়ের এই ‘বিপ্লব’ সাধনে মুক্তি পেয়েছেন প্রায় দু’শো ‘বন্দি’, এবং কর্তৃপক্ষের মতে, এঁদের প্রায় কেউই ফিরে যাননি কোনও রকম অপরাধমূলক কাজে। কী ভাবে সাধিত হল এই কীর্তি, কেমন ছিল তাঁর ব্যক্তিগত ও শিল্পিত পথ চলা, এই নিয়েই আজ সন্ধ্যা ৬টায় আলিপুর মিউজ়িয়ম প্রেক্ষাগৃহে বলবেন খোদ শিল্পী। দেখানো হবে তথ্যচিত্র লাভ থেরাপি-ও, যাত্রাপথটি ধরা যেখানে।
শহরে নতুন
শহরকে চেনা যায় কী দিয়ে? তার মিউজ়িয়ম আর আর্ট গ্যালারি দিয়ে, বলেন শিল্পরসিকেরা। কলকাতা সেই দৌড়ে কতটা এগিয়ে তা তর্কের বিষয়, তবে এ বিলক্ষণ সুসংবাদ যে এ শহরে নতুন এক শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্ট গ্যালারি খুলে গেল নববর্ষের গায়ে গায়েই: ‘ব্রিজিং কালচার অ্যান্ড আর্টস ফাউন্ডেশন (বি-সিএএফ)’। রিজেন্ট এস্টেটের এই স্টুডিয়ো ও গ্যালারি স্বাধীন শিল্পীদের দেবে শিল্পচর্চা ও প্রদর্শনীর পরিসর, সমসময়ের শিল্পভাবনা উস্কে দেবে আরও, জানালেন কর্ণধার রিনা দেওয়ান। উদ্বোধন করলেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী, গ্যালারির প্রথম প্রদর্শনীটি শিল্পী কৌস্তভ চক্রবর্তীর ‘একোটোন’, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত, বিকেল ৪টা-৮টা।
ভেনেজ়ুয়েলার ছবি
ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সোনালি দিনগুলি নিয়ে হাহুতাশ শোনা যায় শহরের ফিল্ম-চর্চামহলে। সিনে ক্লাবগুলিরও কি দিন গিয়েছে ইন্টারনেট, ওটিটি-র এ যুগে? সবাই একমত হবেন না। এখনও ফিল্মপ্রেমী সবার এক সঙ্গে ছবি দেখা আর কথালাপের জুড়ি নেই, বিশেষত সেই দেশের ছবি হলে— এই প্রযুক্তিধন্য যুগেও যা দেখতে পাওয়া সহজ নয় খুব। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস আগামী ২২-২৬ এপ্রিল এসআরএফটিআই-তে আয়োজন করেছে ভেনেজ়ুয়েলার ছবির উৎসব। প্রথম দিন বিকেল সাড়ে ৪টা ও সন্ধ্যা ৬.১৫-তে দু’টি, বাকি দিন একটি করে ছবি, সন্ধ্যা ৬টায়। পোস্টকার্ডস ফ্রম লেলিনগ্রাদ, ব্লিনদাদো, আজ়ু, ডেজ় অব পাওয়ার-সহ মোট ছ’টি ছবি দেখা যাবে।
পূর্বাপর
কৈশোরে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে, বড়দাদা ফিরিয়ে এনে ভর্তি করে দেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। সম্পূূর্ণ হয়নি সে পাঠ। গোবর্ধন আশ চলে যান মাদ্রাজ, সেখানে দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কাছে শিল্পশিক্ষা। কলকাতায় ১৯৩১-এ আরও অনেকের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ং আর্টিস্টস স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, শিল্পী বন্ধু অবনী সেনের সঙ্গে আর্ট রেবেল গ্রুপ ১৯৩৩-এ। সদস্য ছিলেন ক্যালকাটা গ্রুপ-এরও। বিদ্রোহী, সংবেদনশীল এই শিল্পী ভারতশিল্পের নিজস্ব ভাষার এষণায় ছিলেন আজীবন, তৈরি করে গেছেন বাংলার প্রকৃতি থেকে সমাজের চিত্রায়িত দলিল। তাঁর চার দশকের (১৯২৯-৬৯) চর্চা থেকে একশোটি বাছাই কাজ (ছবি) নিয়ে প্রদর্শনী চলছে ক্যালকাটা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-তে: প্রকৃতিদৃশ্য, প্রতিকৃতিচিত্র, অবতার সিরিজ়, অবয়বী শিশুচিত্র। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত, রবিবার ও ছুটির দিন বাদে দুপুর ২টো থেকে ৮টা।
বিজ্ঞান উৎসব
বড্ড গরম পড়েছে। তা বলে উৎসব হবে না? জগঝম্প ধুমধাড়াক্কার কথা হচ্ছে না, উৎসব আসলে বিজ্ঞান ও তার চর্চা ঘিরে। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়ম (বিআইটিএম)-এ গতকাল থেকে শুরু হয়েছে গ্রীষ্মকালীন বিজ্ঞান-উৎসব, যার পোশাকি নাম ‘অ্যাস্ট্রো নাইটস’। পপুলার সায়েন্স লেকচার, প্রদর্শনী, কুইজ় এবং আরও অনেক কিছু, বিকেল ৫টা-রাত ৮টা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা রত্না কোলের আলোচনা হল গতকাল, আজ ও কাল ওপন-এয়ার সায়েন্স শো আর ভার্চুয়াল সিমুলেশন, আকাশ ও মহাকাশ নিয়ে। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘স্কাই-ওয়াচিং সেশন’, আকাশ পরিষ্কার থাকলে জমবে মজা টেলিস্কোপে।
লেখা আজীবন
সত্তর দশকে তাঁর উপন্যাস একদিন সূর্য চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল নীতীশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। সর্বশেষ উপন্যাস প্রাণের মানুষ-এর উপজীব্য রাজনারায়ণ বসুর জীবন। সুনীল দাসের হাতেখড়ি লেখিকা নলিনী দাশের কাছে, লিখেছেন তিনশোরও বেশি ছোটগল্প, চোদ্দোটি উপন্যাস, সাতটি নাটক, ভ্রমণকথা, প্রবন্ধ, ছোটদের গল্প; সম্পাদনা করেছেন শিলালিপি পত্রিকা। মিউনিখের গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-এর মেধাবৃত্তি-সহ নানা সম্মাননায় ভূষিত; তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ‘সংবর্ত’ অংশ নিয়েছে ম্যাঞ্চেস্টার, বার্লিন, টেমপ্লিন ও ঢাকায়, নাট্যোৎসবে। জার্মান পরিচালক হ্বোলফ্রাম মেরিং-এর সঙ্গে যুগ্ম নির্দেশনায় নির্মাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর-ও। আজীবন চেতলা-নিবাসী মানুষটি সম্প্রতি প্রয়াত হলেন একাশি বছর বয়সে। আগামী ২৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার, সন্ধে সাড়ে ৬টায়, তপন থিয়েটারের তাপস-জ্ঞানেশ সভাঘরে তাঁকে স্মরণ করবেন স্বজন ও বন্ধুরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy