এ পথেই জলাধারে ঢুকছে বৃষ্টির জল। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
কানহেরি গুহা। কানহেরি অর্থাৎ কৃষ্ণগিরি। মুম্বইয়ের পশ্চিম শহরতলি অঞ্চলে পর্বতের কোলে রয়েছে এই গুহা। খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি সেই গুহায় যাওয়ার পথে তিনি প্রথম দেখেছিলেন পাথরের চৌবাচ্চা, যেখানে বৃষ্টির জল ধরে রেখে ব্যবহার হত। “ওঁরা যদি পারতেন, আমরা কেন নয়!”— তাঁর এই ভাবনা থেকেই শুরু হয়েছিল বৃষ্টির জল ধরে রাখা। এ জন্য রাত দুটোতেও বিছানার আরাম ছেড়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে যেতে পারেন!
বাইপাসের ধারে পূর্বালোকের বাসিন্দা শ্রাবনী সিকদার জল বাঁচানোর কাজটা শুরু করেন নব্বইয়ের দশকের শেষে। পূর্বালোকে বাড়ি করে আসার কিছু দিন পরে দেখলেন, ভূগর্ভস্থ জলে লোহা বেশি থাকায় নষ্ট হচ্ছে চুল, মার্বেলের মেঝে, জামাকাপড়। জলের জন্য ডাল খেতেও ভুলতে বসেছিলেন। অতঃপর শুরু করলেন হাঁড়ি, বাসন, বালতিতে বৃষ্টির জল ধরে রেখে ভাত-ডাল রান্না। স্বাদ পেয়ে গোটা রান্নাঘর সামলানোর দায়িত্ব পড়ল বৃষ্টির জলের উপরে। পাশে দাঁড়ালেন স্বামী। ২৫০০ লিটার করে জল ধরে রাখতে পারে, এমন দু’টি ভূগর্ভস্থ জলাধার তৈরি করলেন। একটির জলে ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা হয়। অন্যটির জল শুধু রান্না-খাবারে ব্যবহার হয়। কোনও শোধন ছাড়া সেই জল ১৭ বছর ধরে খাচ্ছে সিকদার পরিবার। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রাক্তন অধ্যাপক সমীররঞ্জন সিকদার বলেন, “জলাধার খালি হলে বছরে এক বার ব্লিচিং দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। আট মাসের হিসেবে অতিরিক্ত দু’মাসের হাতে রেখে জল ধরা হয়। তাই প্রতিটি ফোঁটা আমাদের কাছে দামী।”
বৃষ্টি হলে ছাদের পাইপ দিয়ে তা সরাসরি জলাধারে ঢোকে। যে জলাধার রান্নার কাজে ব্যবহার হয়, তাতে বৃষ্টির প্রথম জল ঢোকার আগে খানিকটা পাইপ ঘুরিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ, ছাদে তখন ময়লা থাকে। তবে দু’টি জলাধারের জল ঢোকার পাইপেই তিন ধাপে মশারির জাল লাগিয়ে ময়লা আটকানোর ব্যবস্থা আছে। স্বাদে হুবহু গঙ্গার জল। দীর্ঘ বছর ওই জল খেয়ে পেটের অসুখ হয়নি বলেই জানাচ্ছে সিকদার পরিবার।
সংরক্ষণ: বসু বিজ্ঞান মন্দিরের তৈরি বৃষ্টির জল রাখার আধারের নকশা।
কলকাতা পুরসভার জল, পরিশোধন যন্ত্রের জল, সাগরের জল এবং সিকদার দম্পতির জলাধারে সংরক্ষিত বৃষ্টির জল কলকাতার আঞ্চলিক জল পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, বৃষ্টির জলে অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য (পিএইচ) নির্দিষ্ট মাপকাঠির মধ্যেই রয়েছে। ওই জলে ব্যাক্টিরিয়া মেলেনি। ফ্লুয়োরাইডের (যা হাড় এবং দাঁতকে ক্ষয় করে) মাত্রাও কম। রুক্ষতা নেই বললেই চলে। ফলে চুল এবং ত্বক রুক্ষ হওয়ার আশঙ্কাও কম হয়।
কোনও রকম পরিশোধন ছাড়া বৃষ্টির জল পান স্বাস্থ্যসম্মত? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক অপূর্ব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যেখানে জল রাখা হচ্ছে, তা পরিচ্ছন্ন থাকলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বৃষ্টির জল পানের উপযুক্ত। উত্তর ভারতে এ ভাবেই জল ধরে খাবারের কাজে ব্যবহার হয়।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়ের শিক্ষক তড়িৎ রায়চৌধুরীর মতে, “আরও এমন দৃষ্টান্ত গড়ে তোলা উচিত। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের ভাষায় বৃষ্টির জল ‘সুপার ফাইন ওয়াটার’। যেমন, মাঝ সমুদ্রের জল সব থেকে দামী, অনেকটা তেমনই। তবে রান্নায় ব্যবহৃত জলের সংরক্ষণ পদ্ধতিতে যেন পরিচ্ছন্নতা থাকে, সেটা ভুললে চলবে না। ফিটকিরির মতো পরিশোধক জলে দেওয়া যেতে পারে।” শিল্প অধ্যুষিত বসতিতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করলে তা পরীক্ষা করে ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
জল নিয়ে দেশজোড়া শোরগোল প্রসঙ্গে সমীরবাবু জানান, এত সমস্যাই থাকে না, যদি বাড়িতে ন্যূনতম খরচে বৃষ্টির জল মানুষ ধরে রাখেন। প্রয়োজন মাটির উপরে জলাধার এবং পাইপ। ব্যস, এ ভাবেই জলের যোগানে স্বনির্ভর হয়ে উঠুন শহরবাসী।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy