সুকুমার রায়ের (১৮৮৭-১৯২৩) বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তী ছেলেবেলার দিনগুলি বইতে লিখছেন, “যে বাড়িতে আমাদের জন্ম হয়েছিল আর শিশুকাল কেটেছিল সেটা ছিল একটা বিরাট সেকেলে ধরনের বাড়ি। তার বাইরের অংশে আমাদের স্কুল হত, ভিতরের অংশের দোতলায় আমরা থাকতাম আর তিনতলায় আমাদের দাদামশাইরা থাকতেন।” ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের সেই বাড়িতে বহু ব্রাহ্ম পরিবারের বাস ছিল। সামনেই ব্রাহ্ম-সমাজ-মন্দির, এলাকার নাম ব্রাহ্ম-সমাজ পাড়া। আর স্কুলটি, ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। এই পরিমণ্ডলেই বড় হয়ে ওঠা সুকুমার রায়ের (ছবিতে)।
চঞ্চল, আমুদে, উৎসাহী বালক সুকুমার (ডাকনাম তাতা) দুরন্তপনা আর খেলাধুলোয় ভাইবোনদের দলনেতা। কলের খেলনা ঠুকে, বাজনা ভেঙে দেখতেন, কী ভাবে চলে! সেই অসীম কৌতূহলই অসামান্য মেধার স্ফুরণ ঘটায়। মজার গল্পে হাসানো, কিম্ভূত ভঙ্গিমায় চমকে দেওয়া। হয়তো বড় হয়ে সে সবই পাগলা দাশু বা হ য ব র ল-এর চরিত্রগুলোয় ধরা দেয়। ছোটবেলা থেকেই ভাষা, সাহিত্যের উপরেও আশ্চর্য দখল। আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রীর মুকুল পত্রিকায় ‘নদী’ কবিতার প্রকাশ। একটু বড় হয়ে সমাজ-রাজনীতি নিয়ে স্বতন্ত্র মতামত, সুকুমার হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত তার্কিক। এক বার প্রায় জোর করেই বায়োস্কোপ-বিরোধী মাস্টারমশাইকে ছবি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিজের ভুল শেষ পর্যন্ত মেনেও নিয়েছিলেন শিক্ষক। নাটক লিখেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে, আবার স্বদেশি দ্রব্যের আতিশয্য নিয়ে ঠাট্টা করে গানও বেঁধেছেন। তৈরি করেছেন নাট্যদল ‘ননসেন্স ক্লাব’, প্রকাশ করেছেন মুখপত্র সাড়ে-বত্রিশ ভাজা।
এর পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে ইংল্যান্ড, সেখান থেকে ‘ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’ উপাধি নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। এ বার গুরুদায়িত্ব— ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ ও সন্দেশ পত্রিকার ভার; সেই সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের ব্যস্ততা। ইতিমধ্যে বার তিনেক বাড়ি পাল্টেছেন তাঁরা, উপেন্দ্রকিশোরের ফোটোগ্রাফি আর ছাপাখানার কাজকর্মের জন্য। প্রথমে শিবনারায়ণ লেন, তার পর সুকিয়া স্ট্রিট, শেষে গড়পার রোড। কিন্তু সুকুমারের ক্রিয়াকলাপ, সবাইকে নিয়ে নানা উদ্যোগ কখনও থেমে থাকেনি। এমনকি শেষ দু’বছর রোগশয্যাতেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন।
এত ক্ষমতার আধার মানুষটিকে কোনও এক আলোচনায় বা দুই মলাটের সীমাবদ্ধতায় নিশ্চিত ভাবেই ধরা সম্ভব নয়। তবু গত ৩০ অক্টোবর, শুক্রবার তাঁর ১৩৩তম জন্মদিনে ব্রাহ্ম সমাজ যে অনলাইন আলোচনাসভাটির আয়োজন করল, তাতে ব্যক্তি সুকুমারের নানা দিক তুলে ধরার ঐকান্তিক প্রয়াসটি সাধুবাদযোগ্য। সীমিত সময়ের পরিসরে চমৎকার মননশীল আলাপচারিতায় উঠে এল লেখা, সম্পাদনা, ফোটোগ্রাফি, মুদ্রণ-সহ আরও বহু কর্মকাণ্ডের নায়কের ব্যাপ্ত পরিচিতি। শিল্পী সুকুমারকে নিয়ে বললেন দেবাশীষ দেব, ‘সুকুমার ও সন্দেশ পত্রিকা’ বিষয়ক বহু গল্প ও অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন প্রাক্তন আমলা ও রায় পরিবারের সদস্য প্রসাদরঞ্জন রায়। সংগঠক হিসেবে সুকুমার রায়ের ভূমিকা জানা গেল গবেষক অর্ণব নাগের কথায়।
এ দিন সমাজমাধ্যম জুড়েও ছিলেন সুকুমার। রবীন্দ্রজয়ন্তী বা গাঁধীজয়ন্তীতে যেমন প্রায় সকলেই তাঁদের নিয়ে কিছু লেখেন, কেউ আঁকেন, সুকুমারের জন্মদিনেও তেমনই শ্রদ্ধার্ঘ্যে ভরে উঠেছিল ফেসবুকের ‘নিউজ় ফিড’। যে যাঁর মতো করে মানুষটির সম্পর্কে জানা-অজানা গল্প শুনিয়েছেন, লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁর কৃতিত্বকে স্মরণ করেছেন। সমাজমাধ্যমে উঠে এসেছে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ভগ্নপ্রায় বাড়িটির ছবিও।
মাত্র ৩৬ বছরের জীবন শেষ হয়েছে ১৯২৩-এ, এত বছর পরেও সুকুমারের অমিত প্রতিভা ও প্রেরণার দিকচিহ্নগুলি চিনে নেওয়া যাচ্ছে ঠিক।
শতবর্ষের প্রাপ্তি
মার্ক্সবাদী সমাজতত্ত্ব থেকে বঙ্গীয় নবজাগরণ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস— তাঁর মননক্ষেত্র সুবিস্তৃত। তাঁর গবেষণাগ্রন্থগুলি থেকে উপকৃত হয়েছেন বিদ্যোৎসাহী বিশিষ্টজন, অগণিত ছাত্রছাত্রী। অথচ প্রচারের আলোর প্রত্যাশী ছিলেন না কখনও, এ কাজ তিনি করে গিয়েছেন নীরবে। আগামী কাল, ৩ নভেম্বর শতবর্ষ পূর্ণ করছেন অরবিন্দ পোদ্দার (ছবিতে)। জন্ম শ্রীহট্টে, স্কুলশিক্ষা ময়মনসিংহে, তার পর থেকে কলকাতাতেই। তাঁর বিদ্যাচর্চার স্বাতন্ত্র্য রাজনৈতিক বীক্ষায়, দু’টিই ওতপ্রোত জড়িত। ১৯৪০ সালে অন্তরিন হন, গ্রেফতার ১৯৪৩-এ, বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্তকুমার বসুর সঙ্গে বন্দি ছিলেন। ১৯৪৬-এ মুক্তি পাওয়ার বছরেই এমএ, ১৯৫১ সালে ডি ফিল। অধ্যাপনা করেছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডি-র ফেলোও ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর পথিক, রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্রমানস-এর মতো গ্রন্থের লেখক, শতবর্ষী মানুষটির স্বস্থ, বাঙ্ময় উপস্থিতি এই শহরের প্রাপ্তি।
কত অজানারে
তথ্যচিত্র তৈরির সময়ে তাঁর সত্যজিৎ-আবিষ্কারের ও নিজের শিল্পসত্তা নতুন করে উপলব্ধির কথা জানালেন গৌতম ঘোষ। সন্দীপ রায় তুলে ধরলেন সত্যজিতের সাহিত্যরচনার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ ও রামকৃষ্ণ মিশন রেসিডেনশিয়াল কলেজ, নরেন্দ্রপুরের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কলেজের ইংরেজি বিভাগ ১৩-১৪ অক্টোবর আয়োজন করেছিল দুই দিন ব্যাপী ওয়েবিনার, সেখানেই মূল আকর্ষণ দুই বিশিষ্ট চিত্রপরিচালকের সত্যজিৎ-দর্শন। এ ছাড়াও আলোচনা হয় সত্যজিতের সাহিত্যরচনায় বিজ্ঞান-প্রসঙ্গ, গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির প্রথম দিকের দৃশ্যাবলির আলোয় সত্যজিতের ইতিহাসচেতনার বিশ্লেষণ, বাংলা ও ভারতীয় ছবির ক্রমবিকাশে সত্যজিৎ ও সমকালীন পরিচালকদের উত্থানের ইতিহাস, সত্যজিতের চিত্রশিল্পে ‘বাওহাওস’ শিল্পধারার প্রভাব নিয়ে। ‘ফেলুদা’ কী করে হয়ে উঠল সমকালীন সমস্যাগুলি মোকাবিলার মাধ্যম, সত্যজিতের ছবির ছোট চরিত্রগুলি কী ভাবে ছবির বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে, কথা হল তা নিয়েও। আলোচনায় ছিলেন মৈনাক বিশ্বাস, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, পিনাকী দে, অনুষ্টুপ বসু, সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ রায়, ঋদ্ধি গোস্বামী।
দুই মনীষী
বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সাম্প্রতিক ‘শিবপ্রিয় শ্যামাদাস চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’-য় সম্প্রতি উঠে এল রজার বেকন ও অক্ষয়কুমার দত্তের বিজ্ঞানচিন্তার ধারা। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ শতকের গোড়ায় নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স বিষয়ক গবেষণায় অধ্যাপক শিবপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের অবদান প্রসঙ্গে বলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়। লেখক ও বিজ্ঞান-ইতিহাস গবেষক মানসপ্রতিম দাস তাঁর ‘আ ব্রিজ অ্যাক্রস সিক্স সেঞ্চুরিজ়’ শীর্ষক বক্তৃতায় ত্রয়োদশ শতকের ব্রিটিশ চিন্তাবিদ রজার বেকন এবং উনিশ শতকের বাঙালি চিন্তাবিদ অক্ষয়কুমার দত্তের বিজ্ঞান ভাবনার সংযোগসূত্রগুলি দেখিয়ে দেন। কয়েক শতকের ব্যবধানে দুই সারস্বত ব্যক্তিত্বের শিক্ষাজীবন, সমকালীন সমাজভাবনা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার— নানা বিষয় তুলে ধরা হয়। আলোচনা হয় বেকন ও অক্ষয়কুমারের ঈশ্বরভাবনা ও বিজ্ঞান ভাবনার সমান্তরাল পথ চলা নিয়েও।
অনুবাদেন্দ্র
“মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়— নিজ-নিজ মর্জি অনুযায়ী প্রচণ্ড মজারু।... অধুনা চতুর্দিকে চাউর হলেও, পশ্চিম-নন্দিত প্রাচী-র কৃতিসন্তান, দীর্ঘদেহী সত্যজিৎ রায়-কে, মানববাবুই প্রথম বিভূষিত করেছিলেন Orient Longmaখেতাবে।” মানববাবুকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে এও খেয়াল করিয়ে দিতে ভোলেন না শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়— আশির দশকে এক সাময়িকীতে মানবেন্দ্র লিখেছিলেন ধারাবাহিকী ক্যালিবানের পৃথিবী। পঞ্চাশের দশক থেকে ‘ক্যালিবানি স্পর্ধা-ঔদ্ধত্যের হুতাশনে লাতিন আমেরিকায়, ক্যারিবিয়ান্সে, কাব্যে-উপন্যাসে’ ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা তাতে। এই অনবদ্য গদ্যটি দিয়েই শুরু হয়েছে হরপ্পা-র (সম্পা: সৈকত মুখোপাধ্যায়) বৈদ্যুতিন পুস্তিকা ও শ্রদ্ধার্ঘ্য মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কবিতা নিয়ে লিখেছেন অভিজিৎ রায়, ‘অনুবাদেন্দ্র’ শিরোনামে সৌম্যদীপ। প্রচ্ছদ ও শিল্পনির্দেশনায় সোমনাথ ঘোষ।
শূন্য করে
পাঠভবনের প্রাক্তন শিক্ষক পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় (ছবিতে) বেশি পরিচিত ছিলেন ‘লেবুদা’ নামে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা শান্তিনিকেতনের সামগ্রিক মানবিক পরিচয়টিকে কিছুটা মলিন করে দিচ্ছে, এই সময়েই ঠিক পথের সন্ধান দেওয়ার জন্য এই নম্র ও নিরহঙ্কারী মানুষটির প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। বীরভূমের হাটসেরান্দি গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবারে ১৯৩৬-এ জন্ম, বিশ্বভারতীতে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়তে। সেই থেকেই আজীবন শান্তিনিকেতনে। পাঠভবনে শিক্ষকতা ছিল তাঁর ‘প্যাশন’, আর আশ্রমিক জীবনচর্যাকে করে নিয়েছিলেন জীবনের ‘মিশন’। শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতিকে স্বভাবে, আচরণে, প্রজ্ঞায় লালন করেছেন সযত্নে। তাঁর ক্লাস ছিল ছেলেমেয়েদের কাছে মনোরম অভিজ্ঞতা, প্রাক্তনীরা শান্তিনিকেতনে এলে এক বার হলেও প্রণাম করে আসতেন তাঁকে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন শান্তিনিকেতন থেকে নামের এক ধরনের সংবাদ-চিঠি, যা পরে সময়হারা শান্তিনিকেতন (দে’জ পাবলিশিং) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নিয়মিত লিখেছেন দেশ পত্রিকাতেও। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাঁর কয়েকটি গবেষণাধর্মী বই— রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, কবিপত্নী মৃণালিনী, মাধুরীলতার চিঠি, রবীন্দ্র পরিকর ও হে মহামরণ। চলে েগলেন গত ২৪ অক্টোবর, শান্তিনিকেতনের অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়টি রিক্ততর হল তাঁর প্রয়াণে।
তার প্রতীক্ষায়
n একচল্লিশ পেরিয়ে বিয়াল্লিশে পা কলকাতার নাট্যদল ‘গণকৃষ্টি’-র। জন্মদিনে ৭ নভেম্বর, শনিবার তারা ছোট্ট একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস মঞ্চে। দুপুর আড়াইটেয় স্যামুয়েল বেকেট-এর বিশ্ববিখ্যাত নাটক ওয়েটিং ফর গোডো অবলম্বনে তাদের নতুন প্রযোজনা তার প্রতীক্ষায়-এর প্রথম অভিনয়। দ্বিতীয়ার্ধে বিকেল সাড়ে ৫টায় ‘ধরণী ঘোষ স্মৃতি সম্মান’ প্রদান অনুষ্ঠান, প্রাপক চলচ্চিত্র ও নাট্য সমালোচক নির্মল ধর। গণকৃষ্টির প্রয়াত সভাপতির স্মরণে ‘তীর্থঙ্কর মুখোপাধ্যায় স্মারক ভাষণ’ দেবেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ও শিক্ষক গৌতম ঘোষ, বিষয় ‘থিয়েটার ও সঙ্গীতের পারস্পরিক সম্পর্ক’। শেষেও একটি প্রযোজনা, এভাল্ড ফ্লিসার-এর মূল নাটক অবলম্বনে তোমার আমি।
ভাল রে ভাল
নরেন্দ্রপুরে সম্প্রতি শুরু হওয়া কফিশপ ‘আবার বৈঠক’ সুকুমার রায়ের জন্মদিন উপলক্ষে সেজে উঠেছে আবোল তাবোল-কে মনে রেখে। মেনু কার্ড থেকে দেওয়ালচিত্রে সুকুমারের অত্যাশ্চর্য রসরচনার নানান চরিত্র ও উদ্ধৃতি। ‘হেভি মিল’ (সঙ্গের ছবিতে) এখানে ‘হাতিমি’, ‘সুইট ডিশ’— ‘ভাল রে ভাল’। রাখা আছে আবোল তাবোল-এর কোস্টার, ছোটদের টি-শার্ট। আছে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের প্রাক্তনীদের নানা উদ্ভাবনী, সবই আবোল তাবোল প্রাণিত। একটি সেলফি-জ়োনও আছে, ‘হুঁকোমুখো’-র সঙ্গে নিজস্বী তোলা যাচ্ছে সেখানে।
ঘরে বসেই
n কোভিড-আবহে পিছিয়ে গিয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। তা বলে কি ছবি দেখা থেমে থাকবে? চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মুখে হাসি ফোটাতে এ সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, চলবে ৫-৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এ বছর ভারতে এই ছবি-উৎসবের রজত জয়ন্তী বর্ষও। পুরো উৎসবই অনলাইন, তাই ঘরে বসেই ইউরোপের সাম্প্রতিকতম এবং কান, ভেনিস, বার্লিন, লোকার্নো-র মতো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারজয়ী একগুচ্ছ ছবি দেখার সুযোগ। থাকছে বিশ্ববিশ্রুত পরিচালকদের তৈরি ধ্রুপদী ও সিনেমার ইতিহাসে যুগান্তকারী কিছু চলচ্চিত্র— ইঙ্গমার বার্গম্যানের পারসোনা, লুই বুনুয়েলের দি এক্সটার্মিনেটিং এঞ্জেল, অ্যাগনেস ভারদা-র ক্লিয়ো ফ্রম ফাইভ টু সেভেন, ক্রিস্তফ কিসলস্কি-র থ্রি কালার্স: ব্লু, রেইনার ফাসবেন্ডার-এর ফিয়ার ইটস দ্য সোল, আন্তোনিয়ো পিয়েত্রাঞ্জেলি-র আই নিউ হার ওয়েল, মিলোস ফরমান-এর লাভস অব আ ব্লন্ড। বিশেষ বিভাগ ‘পোয়েট্রি অন স্ক্রিন’-এ দেখানো হবে সত্যজিৎ রায়ের অপরাজিত ও চৈতন্য তামহানে-র মরাঠি ছবি কোর্ট-ও। এ বারের উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে তৈরি ছ’টি ছোট ছবি, তার মধ্যে আছে নীলমাধব পন্ডার ছবি মেঘা’স ডিভোর্স। রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত তথ্য, ছবির সম্পূর্ণ তালিকা ও সময়সূচি জানা যাবে ইইউএফএফইন্ডিয়া ডট কম ওয়েবসাইট থেকে।
কোভিড-বিচার
করোনার প্রভাব কতটা পড়েছে বিচার ব্যবস্থায়? এই প্রশ্নই উঠে এল কলকাতার ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ়-এর সাম্প্রতিক ওয়েবিনারে, বিষয় ‘কোভিডের মুখোমুখি পশ্চিমবঙ্গের বিচারব্যবস্থা’। জানা গেল, করোনা-পরিস্থিতিতে বিচার ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, আবার কিছু দীর্ঘমেয়াদি লাভও হয়েছে। অনলাইন ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, বিচারে এসেছে স্বচ্ছতা। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে কলকাতা বরাবর দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য, সেই সম্মান বজায় থাকা নিয়ে সংশয়। গ্রাম ও মফস্সলের বিচারপ্রার্থীরা অনলাইনের সুযোগ কতটা পাচ্ছেন, প্রশ্ন তা নিয়েও। রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রের সভাপতিত্বে আলোচনায় ছিলেন চার আইনজীবী— তমালকান্তি মুখোপাধ্যায়, দীপন সরকার, অরিন্দম মিত্র ও সায়ক চক্রবর্তী। আন্তর্জাল-মাধ্যমে লন্ডন থেকে যোগ দেন ব্রিটিশ আইনজীবী জস উপ্পলও।
অনন্ত শিল্পযাত্রা
তাঁর ভাস্কর্যে পাওয়া যায় কবিতার রূপকল্প ও দ্যোতনা। বিশিষ্ট ভাস্কর গোপীনাথ রায়ের (১৯৫৩-২০১৭) শিল্পকৃতিকে বরেণ্য শিল্পী যোগেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘অসাধারণ, অবিস্মরণীয়’— পাথরের বুকে কাব্যিক আশ্রয় পেয়েছে সমুদ্র, নদী, জলপ্রপাত, সজল মেঘ, ডানা ভাঙা পাখি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পাথর, ধাতু, কাঠে গড়েছিলেন তাঁর সাঙ্গীতিক ভাস্কর্যগুলি (ছবিতে তেমনই একটি)। ১৯৫৩ সালে হাওড়ার শিবপুরে জন্ম, স্বর্ণকার পরিবারের নিজস্ব বৃত্তির অভিজ্ঞতা গোপীনাথকে দিয়েছিল ভাস্কর্যের উদ্বোধ। গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট-এর ছাত্র, পরে েসখানেই শিক্ষক। যুক্ত ছিলেন কলকাতার ‘সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’, ‘ক্যানভাস আর্টিস্ট সার্কল’, ‘ওপেন উইন্ডো’-র মতো শিল্পী দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে। ২০১৭-র ২৮ অক্টোবরে অকালপ্রয়াত শিল্পীর স্মৃতিতে কলকাতার নতুন ডিজিটাল শিল্প-পরিসর ‘আর্টওয়েভ ইন্ডিয়া’ তাদের ওয়েবসাইটে গোপীনাথের শিল্পকর্মগুলির অনলাইন প্রদর্শনী করছে। ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট শিল্পী চিত্রভানু মজুমদার। এক সৃষ্টিশীল সত্তার অনন্ত শিল্পযাত্রার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পাবেন রসজ্ঞরা।
রুশ পাত
গত ২০ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল শেফ’স ডে’ বা আন্তর্জাতিক রাঁধুনি দিবস উপলক্ষে অনলাইন অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল গোর্কি সদনের রাশিয়ান সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড কালচার। বিষয়, রুশ কুইজ়িন বা খাবার ও রন্ধনপ্রণালীর ইতিহাস। সে দেশের খাবার ও স্বাদের বিশিষ্টতাই ছিল আলোচনার বিষয়। ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক ঘটনাক্রম, ধর্মীয় প্রভাব— সবই চালিত করেছিল প্রাচীন রুশ রন্ধনশালাকে। শীতের দেশ, তার ওপর মঙ্গোল আক্রমণ, অতএব রুটি সুপ শরবত সবই ‘ফার্মেন্টেড’ হত। জানা গেল ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ‘মস্কো রন্ধনপ্রণালী’-র কথাও। মাছ আর ক্যাভিয়ারের সঙ্গে প্রাচ্য প্রভাবে তখন ডাম্পলিং-ও ঢুকে পড়েছে রুশ হেঁশেলে। এর পর এসেছে ইউরোপীয় কুইজ়িন, ডিমের নানা পদ খেতে শিখেছেন রাশিয়ানরা। আবার, জ়ার থেকে সোভিয়েট আমলে সামাজিক কারণেই পাল্টে গিয়েছে জনগণের খাদ্যতালিকা। তবে ঐতিহ্যও আঁকড়ে থেকেছে দেশ। বিটের সুপ ‘বোর্শ’, আমাদের ডেভিল-সদৃশ ‘কিয়েভ’ বা অধুনা সর্বত্র জনপ্রিয় মাংসের ‘স্ত্রোগানফ’-এর মতো পুরনো কিছু রান্নার প্রণালী এ দিন সবিস্তারে আলোচিত হয়।
মুখ ঢেকে যায়
‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’ ও ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র যৌথ উদ্যোগে চলছে ওয়েবিনার সিরিজ় ‘লার্ন টুগেদারনেস’। তারই ৬ অক্টোবরের পর্বে বিষয় ছিল বিজ্ঞাপন জগতে লিঙ্গচেতনা। রিনা দিওয়ানের সঞ্চালনায় কথোপকথনে ছিলেন রংগন চক্রবর্তী, রিমা মুখোপাধ্যায়, শ্রাবস্তী মজুমদার ও কোয়েল ঘোষ। বক্তারা দেখালেন, বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় প্রচলিত দ্বৈতভেদ— গৃহস্থালি ও সাজসজ্জার পণ্য যথা ভোজ্য তেল, ওয়াশিং মেশিন, ক্রিম ইত্যাদি বিজ্ঞাপনের মুখ নারী। অন্য দিকে জীবন বিমা, গাড়ির প্রচারে পুরুষরা, এবং এই মেয়েলি-পুরুষালি ভেদাভেদের মধ্যে সমকামীদের সম্মানজনক স্থান নেই। এই প্রভেদ বিপজ্জনক, কারণ এ ধরনের বিজ্ঞাপন সমাজে প্রচলিত ধারণা থেকেই উদ্ভূত। আবার এই বিজ্ঞাপন দেখেই গঠিত হয় সমাজের মন, বাড়ে মেয়েদের প্রতি অপরাধ ও তৃতীয় লিঙ্গের অবমাননা। আলোচনায় বেরিয়ে এল অচলায়তন ভাঙার উপায়ও— এই বিষয়ে সংবেদনশীল বিজ্ঞাপন তৈরি জরুরি। স্কুল স্তর থেকেই শিশুর মনে মুক্ত চিন্তার আবহ তৈরির দায়িত্ব বড়দের।
ট্যাক্সিপুরাণ
n টেক্সাসের সার্জিয়ো নিজের ট্যাক্সির খোলে গুছিয়ে রাখেন খাবার, জল, নরম পানীয়ের বোতল। তাঁর ‘অ্যামিগো শাটল’ ট্যাক্সিতে যাত্রী নিয়ে প্রায়ই দূরদূরান্তে ছুটতে হয়, এমনকি মেক্সিকোও— তাই এ ব্যবস্থা। রাতভর বার্লিনের রাজপথে ট্যাক্সি নিয়ে ছুটতে আপত্তি নেই বাম্বি-র। একা মেয়ে, তাতে কী, বাড়িতে প্রিয় পোষা কুকুরটিকে সামলে বেরিয়ে পড়েন ঠিক, গল্পে গল্পে যাত্রীদের পৌঁছে দেন নাইটক্লাব থেকে বাড়ি বা অন্য রাত-ঠিকানায়। ডাকার-এর ধুলো-ওড়ানো ঘিঞ্জি রাস্তায় ট্যাক্সি চালিয়ে সুখ হয় না মামাদু-র, এ শহরে মানুষের হাতে টাকা নেই তেমন। ব্যাঙ্ককের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন বহু ট্যাক্সিচালক, বাড়ি অবধি যান না। টোনি কিন্তু তেমন নন। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কসোভোর রাজধানী প্রিশটিনায় গাড়ি চালানোর অবসরে গুচ্ছের খবরকাগজ-টুকরোয় ভাল থাকার ওষুধের খোঁজে থাকেন প্রবীণ ট্যাক্সিচালক দেস্তান। পাঁচ শহরের এই পাঁচ ট্যাক্সিচালককে নিয়েই ৮২ মিনিটের চমৎকার তথ্যচিত্র ওয়র্ল্ড ট্যাক্সি বানিয়েছেন জার্মান পরিচালক ফিলিপ মায়ার। কলকাতার গ্যেটে ইনস্টিটিউট ম্যাক্সমুলার ভবন-এর ‘ডকু ফোরাম’-এ সম্প্রতি দেখানো হল তা। কলকাতার পথে হলদে ট্যাক্সিরাও (ছবিতে) বিখ্যাত, দিনবদলের হাওয়ায় তারা কি মুছে যেতে চলেছে ক্রমশ? এই শহর ও তার ট্যাক্সিচালকেরা ফিলিপের ট্যাক্সিপুরাণের দ্বিতীয় পর্বে ঠাঁই পাবেন কি না, তারই অপেক্ষা।
আমরা তোমারই
‘‘বড়রা বলতেন, সকালের ট্রেনে গেলে সন্ধেয় চাকরি পেয়ে যাবে। দক্ষিণীরা বিশ্বাসী আর কর্মদক্ষ, তাই শিল্প-শহরগুলিতে তাঁদের দারুণ চাহিদা।’’— বলছিলেন রাজু রামন। ‘সাপোর্ট এল্ডার্স’ সংস্থা প্রবীণদের সঙ্গে যে আন্তর্জালিক ধারাবাহিক কথালাপ শুরু করেছে, তারই সাম্প্রতিক একটি পর্বে কলকাতাবাসী তামিলদের কথা ও কাহিনি শোনালেন তিনি। জানালেন, কী ভাবে এই গোষ্ঠী কলকাতার মনন ও শিক্ষণকে ঋদ্ধ করেছে, দোসা-ইডলির স্বাদে মজিয়েছে বাঙালি রসনা। প্রথম প্রথম ভেস্তি পরিহিত, অন্য রকম শাড়ি-গয়নায় অলঙ্কৃত তামিল নর-নারী দেখলে ভেসে আসত টিপ্পনী। সর্ষের তেল আর নারকেল তেলের ঠোকাঠুকি ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বন্দ্বের মতোই মজাদার। ধীরে ধীরে বাঙালির আড্ডার মেজাজে মিশে যান তামিলরা। কলকাতা তাঁদের কাছে শেখে ভরতনাট্যম, কর্নাটিক সঙ্গীত। কলকাতার আকাশ ঝিলমিল বহু তামিল নক্ষত্রের আলোয়— সি ভি রমন, এন বিশ্বনাথন, বলরাম-থঙ্গরাজ। এ শহরকেই তো উষা উত্থুপ বলেছেন, ‘আমরা তোমারই কলকাতা’। মরাঠি, মারোয়াড়ি সংস্কৃতিও তিলোত্তমাকে কেমন লাবণ্য জুগিয়েছে, সেই আখ্যায়িকা থাকবে কথামালার আসন্ন পর্বে।
কণ্ঠস্বর
দীর্ঘ দিন ধরে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মননকে পুষ্ট করেছেন তাঁরা— দেবেশ রায়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, নিমাই ভট্টাচার্য। এঁদের স্মরণে ও শ্রদ্ধায় কণ্ঠস্বর পত্রিকা প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা ‘শরতে স্মরণ’। দেবেশ রায়কে নিয়ে লেখাগুলিতে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ, এসেছে তাঁর দেখা উত্তরবঙ্গের কথাও। প্রিয়রঞ্জনবাবুর রাজনীতি ও ব্যক্তি-জীবনের খুঁটিনাটি দিক খানিকটা ব্যক্তিগত রসায়নের আলোতেই দেখেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের সাংবাদিকেরা। মেমসাহেব-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসের স্রষ্টা নিমাই ভট্টাচার্য সম্পর্কিত নিবন্ধগুলি বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর ভূমিকার কথা মনে করায় বিশেষ ভাবে।
হাওয়া কেমন
সাত সমুদ্র পারে আমেরিকায় কাল প্রেসিডেন্ট বাছাইয়ের ভোট, কলকাতাও সে নিয়ে মস্ত উত্তেজিত। ‘আর্লি ব্যালট’ কী বস্তু, ‘ইলেক্টোরাল সিস্টেম’ ব্যাপারটা কেমন— চর্চা চলছে বাঁশদ্রোণী থেকে বেলেঘাটা। সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় কানাকানি: হাওয়া কী বুঝছেন? অতি উৎসাহী জন ভিডিয়ো কলে উন্মুখ: “তোদের ভোটে আমাদের মতো লাইন পড়ে? লাইভে দেখাস তো!’’ কেউ মাস্ক পরে ভোট দেবেন না খুলে, তা থেকেই নাকি বোঝা যাবে কে কার সমর্থক!
অতিমারির শহরে শ্রী আনেন তিনি
ফেলে আসা দেশ-বাড়ির স্মৃতি তখনও টাটকা। তবে এই শহরে নতুন করে জীবন শুরু করার সংগ্রামে অতীতচারী হওয়ার সুযোগ ছিল না বেশি। ব্যতিক্রম দু’-একটি পূজাপার্বণ, যেমন কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। সময় বদলেছে, স্মৃতি রোমন্থন আজও আছে, সেই টান হয়তো খানিক ফিকে। কিন্তু পারিবারিক প্রথা মেনে এখনও ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন হয়। কেউ কলা গাছ, ধান, হলুদ গাছ আর সুপুরি দিয়ে কলাবৌ বানিয়ে কৃষিলক্ষ্মী রূপে পুজো করেন, আবার যে সব পরিবারে এক সময় লক্ষ্মী বসত করতেন বাণিজ্যে, তাঁরা কলার ডোঙা দিয়ে বাণিজ্যতরি সাজিয়ে পুজো করেন। তার মধ্যে ভরে দেন ধান, আরও নানা অর্থকরী ফসল।
কৃষি ও কৃষিভিত্তিক বাণিজ্যের নানা প্রতীক সাজিয়ে আরাধনা করা হয় সমৃদ্ধির দেবীকে। আর তাই লক্ষ্মীপুজোর বাজার যেন শহরের বুকে কয়েক দিনের জন্য হাজির করে একটি গ্রামকেই। বিক্রি হয় পুজোর নানা উপচার, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গ্রামীণ জীবনযাপনের অনুষঙ্গও।
দেবীর পুজো হয় প্রতিমা বা সরাতেও। কোথাও আবার দেবীর বাহন পেঁচার মূর্তিতে শাড়ি পরিয়েও পুজো করা হয়। কুমোরটুলি ও উল্টোডাঙা দক্ষিণদাঁড়ি কুমোরপাড়ায় দুর্গাপুজো শেষ হতেই শুরু হয়ে যায় লক্ষ্মী প্রতিমা তৈরি ও বিক্রির ব্যস্ততা। নানা আকারের লক্ষ্মী প্রতিমার উপর শিল্পীদের তুলির টান শেষে প্রতিমা পাড়ি দেয় শহরতলির বিভিন্ন বাজারে। এমনকি রাজ্যের বাইরেও।
নানা আঙ্গিকের লক্ষ্মী সরাও বিক্রি হয়। সেখানে সবাহন লক্ষ্মী, কোথাও সঙ্গে জয়া-বিজয়াও (ছবিতে)। সরায় কী ভাবে লক্ষ্মীকে আঁকা হবে, তা পারিবারিক রীতিনির্দিষ্ট। কখনও সামনে থেকে (ফ্রন্টাল), কখনও পাশ থেকে (প্রোফাইল) আঁকা ‘একচক্ষু’ সরা। এখন বেশির ভাগ সরা আসে কলকাতার বাইরে, যেমন নদিয়ার তাহেরপুর থেকে। তবে ঔপনিবেশিক শিল্পকলার প্রভাবযুক্ত ‘কুমোরটুলির সরা’-র এক আলাদা ঐতিহ্য আছে। সেই সরা এখন হাতে গোনা কয়েকটি ঘরেই আঁকা হয়। অবশ্য ক্রেতাদের চাহিদায়, ছাঁচের লক্ষ্মীঠাকুর সরার উপর বসিয়ে সাম্প্রতিক কালে ‘রিলিফ সরা’-ও তৈরি হচ্ছে কুমোরটুলিতে।
পরিচ্ছন্ন, শ্রীমণ্ডিত আবহ লক্ষ্মীর প্রিয়। পুজোর জায়গা-সহ পুরো বাড়িই তাই সাজানো হয় লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, ধানের ছড়া, শঙ্খ, পদ্মলতার মতো বিশেষ মোটিফের আলপনা দিয়ে। পুজোর জায়গা সাজানোর জন্য বাজারে এই সময় শোলার তৈরি কদম ফুল, মালা, আরও নানা রকম অলঙ্করণের প্রাচুর্য। আলপনার খাটুনি বাঁচাতে আজকাল অনেকেই বেছে নিচ্ছেন আলপনার স্টিকার। তবে আজও সমাজমাধ্যম ভরে ওঠে নয়নাভিরাম ধ্রুপদী আলপনার অগণিত শিল্পকর্মে। বাড়ির উঠোন, চৌকাঠ পেরিয়ে গৃহকোণে স্নিগ্ধ পূজাস্থলটি পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন। আধুনিক শহরবাসীর প্রয়োজনে তিল ও নারকেলের নাড়ু, খই বা চিঁড়ের মোয়াও ঢেলে বিক্রি হচ্ছে দোকান-বাজারে। তবু ঘরে বসে অল্প হলেও অনেকে নিজের হাতে বানান নাড়ু, মুড়কি। অতিমারি পরিস্থিতি, জিনিসপত্রের আগুন দাম সয়েই ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির দেবীর পুজো হল শহরে।
ছবি: অমিতাভ পুরকায়স্থ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy