গত তিন বছর ধরে কলকাতায় বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা সেই ৩০৪৬টি! নিজস্ব চিত্র।
‘ভুল তথ্য’ দেওয়া নাগরিকের ক্ষেত্রে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু প্রশাসনের ক্ষেত্রে? তা-ও শাস্তিযোগ্যই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কোথায়! যেমন, নিয়ম করে প্রতি বছর বাড়ি ভাঙার পরেও পুর নথিতে বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা একই থেকে যায়। কোনও উচ্চবাচ্য হয় না।
রাজ্য প্রশাসন সূত্র জানাচ্ছে, ‘ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০৫’-এর ৩১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, প্রতিটি জেলা কর্তৃপক্ষকে বিপর্যয় মোকাবিলার রূপরেখা তৈরি করতে হয়। কলকাতার ক্ষেত্রে ওই দায়িত্ব কলকাতা পুরসভার। কিন্তু প্রতি বছর বিপর্যয়ের রিপোর্ট ‘আপডেট’ করার কথা বললেও তা হয় না। বরং বিপজ্জনক বাড়ি সংক্রান্ত তথ্য শুধুই ‘কপি-পেস্ট’ করে চালিয়ে দেওয়া হয়। আর তাই গত তিন বছর ধরে কলকাতায় বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা সেই ৩০৪৬টি!
অথচ কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভূমিকম্প হলে কলকাতার ৪০ শতাংশ বাড়ি ‘হাই রিস্ক জ়োন’ এবং আদি কলকাতা তথা মধ্য কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ৫-৭ শতাংশ বাড়িই ‘সিভিয়র রিস্ক জ়োন’ তালিকাভুক্ত। পুর নথির বয়ান অনুযায়ী, ‘বিহার-নেপাল সীমান্তের বড় ভূকম্পন সমগ্র উত্তরবঙ্গ তো বটেই, কলকাতার দুর্বল কাঠামোগুলির ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক হতে পারে’! ওই রকম গুরুত্বপূর্ণ নথিতে বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকাটা ‘প্রহসন’ ছাড়া আর কী? বলছেন অনেকে!
সংখ্যার এই ধোঁয়াশা কাটাতে ২০১২ সালের ৫ জুন পুর বিল্ডিং দফতর একটি অন্তর্বর্তী নির্দেশিকা জারি করে বলে, ওয়ার্ডভিত্তিক বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা কত, সেই রিপোর্ট কেন্দ্রীয় পুরভবনে নেই। তাই এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারেরা বরো ধরে বিপজ্জনক বাড়ির তালিকা বানিয়ে যেন কেন্দ্রীয় পুরভবনে পাঠান। পুরকর্তাদের একাংশের অনুমান, সেই রিপোর্টই এতগুলো বছর চলে এসেছে।
শুধু কি বিপর্যয় মোকাবিলা সংক্রান্ত রিপোর্টে উল্লিখিত বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা?
২০১৪ সালের ২০ জুন পুর বাজেট পেশ করলেন তৎকালীন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। বাজেট বিবৃতির বিল্ডিং বিভাগের জায়গায় বলা হল,— ‘নগর নবীকরণের উদ্দেশ্যে কলকাতা পৌরসংস্থা নির্মাণ বিধির ১৪২ নম্বর ধারা অনুসারে ভাড়াটিয়া অধিকৃত প্রাচীন, ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলি ভেঙে নতুন, নিরাপদ, বাসযোগ্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহদান করছে, যাতে শহরে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।’ পরের বছর দু’-একটি শব্দের পরিবর্তন-সহ বাজেট বিবৃতি বলল,— ‘নগর নবীকরণে উৎসাহ দিতে ১৪২ নম্বর নির্মাণ বিধি অনুসারে প্রাচীন, ভগ্নদশাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া অধ্যুষিত বাড়িগুলি ভেঙে ফাঁকা জায়গা-সহ নতুন বাসযোগ্য বাড়ি নির্মাণের
ক্ষেত্রে অনুমোদনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে।’ একই বিবৃতি ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ সালের বাজেটেও অপরিবর্তিত থাকল।
‘স্টেট লেভেল বিল্ডিং কমিটি’র এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাজেটে তো আর আলাদা বিবৃতি দেওয়া হয় না। তার বয়ান মোটামুটি একই থাকে।’’ কিন্তু বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যাও একই থাকে? প্রতি বছর বাড়ি ভাঙার পরেও? এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই।
কলকাতার বিদায়ী পুর প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম জানাচ্ছেন, ‘‘বিপজ্জনক বাড়ির নতুন আইনের দরকার। ভাড়াটে-মালিকের ঝামেলা রয়েছে এমন বাড়িগুলির ‘ভ্যালুয়েশন’ করে পুরসভা বা কোনও সংস্থা গঠন করে তা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে। তার পরে আইন মেনে এই সমস্যা দূর করা যেতে পারে।’’
অর্থাৎ, পুর আইনের ৪১২এ ধারার পরে (যেখানে বিপজ্জনক বাড়ি খালি করা, সংস্কার বা পুনর্গঠনের বাড়তি ক্ষমতা পুরসভার রয়েছে) আবারও একটি পুর আইনের ভাবনা! তবে সেই ভাবনা এবং তার বাস্তবায়নের মধ্যে আরও কত বাড়ি ভাঙবে আর প্রাণ যাবে, তা এ শহর জানে না। কিন্তু বাড়ি ভাঙার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কী হবে, তা এক প্রকার জানে কলকাতা। যেমন, বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষ বলবেন, ‘‘প্রতিটা মৃত্যুই দুর্ভাগ্যজনক।’’ নিয়মমাফিক পুর নীতির সমালোচনা, প্রশাসন-পুলিশের অন্দরে বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন চলবে।
শুধু বদলাবে না জীর্ণ বাড়ির ভবিষ্যৎ। ভগ্নপ্রায় ছাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে শহরের অনিবার্য বিপর্যয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy