অপরিচ্ছন্ন: দূষণে কালো আদিগঙ্গার পূর্ব পুঁটিয়ারির অংশের জল। ভাসছে প্লাস্টিক থেকে শুরু করে নানা আবর্জনা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
আগে ভেসে আসত নৌকা বোঝাই ধান, পাট, আনাজপাতি, আরও কত কী! এখন? সেই মরা গাঙে আর বান আসে না। ‘জয় মা’ বলে তরীও ভাসে না। ভাসে শুধুই আবর্জনা, আর পশুর লাশ। জরাগ্রস্ত আদিগঙ্গার মান-সম্মান ফেরানোর আয়োজন বলতে কদাচিৎ নেতাদের প্রতিশ্রুতি। ব্যস। যৌবনের আদিগঙ্গার জলতরঙ্গ ধরা থাকে গুটিকয়েক ছানি পড়া চোখে।
ঘিঞ্জি পূর্ব পুঁটিয়ারি বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এ হেন আদিগঙ্গায় হঠাৎ আওয়াজ, ঝপাৎ! দুই আরোহী নিয়ে আসা মোটরবাইকের থেকে হাল্কা হল ঢাউস আকারের পলিব্যাগ। পুজোর ফুল-মালা, থার্মোকলের প্লেট-সহ খাবারের উচ্ছিষ্টে ঠাসা সেই ব্যাগ সোজা আদিগঙ্গার জলে। দিনভর চলে এমন ছুড়ে ফেলার খেলা। শুধু কী তাই? বাজারের উচ্ছিষ্ট থেকে দৈনন্দিন বাতিল জিনিস— সবই জমে তার পাড়ে। আদিগঙ্গার পূর্ব পুঁটিয়ারির অংশের দুই পাড় যেন অঘোষিত ভ্যাট। বেহাল নিকাশি, ভাঙাচোরা রাস্তা, আবর্জনার স্তূপ পুর পরিষেবার অকেজো চরিত্রের মুখোশ টেনে খোলে।
অথচ ১১ নম্বর বরোর অন্তর্গত আদিগঙ্গার তীর ঘেঁষা এলাকায় বিপরীত ছবি মিলবে পাটুলি, গরফার দিকে গেলে। বরোর ওই অংশে উন্নয়নের ছোঁয়া পথে-প্রান্তরে। লোকে বলে, উন্নয়ন সেখানে এমন ভাবে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে যে, আদিগঙ্গায় আর তার পৌঁছনো হল না। কলকাতা পুরসভার ১১ নম্বর বরোর আদিগঙ্গার পাড়ে কান পাতলে উঠে আসে পুর প্রশাসনের এই দ্বিচারিতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভও।
পূর্ব পুঁটিয়ারি থেকে গড়িয়ামুখী বাঁশদ্রোণী, ব্রহ্মপুর হয়ে আদিগঙ্গার বাঁ দিক ধরে এগোলে ১১ নম্বর বরোর ১১১ থেকে ১১৪ নম্বর ওয়ার্ড। পূর্ব পুঁটিয়ারির খালের উপর দিয়েই গিয়েছে দক্ষিণেশ্বর থেকে কবি সুভাষগামী মেট্রোর লাইন। মেট্রোর সুবিধা পেতে উচ্চতায় দ্রুত বাড়ছে এলাকার পরিধি। কিন্তু, কতটা পরিকল্পিত ভাবে? বাসিন্দাদের দাবি, ‘‘পরিষেবার মান আগের থেকে বাড়লেও মোটেই পর্যাপ্ত নয়। সব কিছুতেই স্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব।’’ ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অসীম দত্তের অভিযোগ, “আধুনিক পরিষেবা বাদ দিন। পরিচ্ছন্নতার দিকেই নজর নেই! মাঝেমধ্যে আদিগঙ্গার দু’পাড় পরিষ্কার হয়। দিন কয়েকেই ‘পুনর্মূষিক ভব’। কেন নিয়মিত পরিষ্কার হবে না?’’
অভিযোগ অস্বীকার করে ১১২ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর, তৃণমূলের অনিতা করমজুমদার বলেন, ‘‘আদিগঙ্গা নিয়মিত পরিষ্কার হয়। ওখানকার বাসিন্দাদের সচেতন হতে হবে।’’ তবে এলাকার অপরিচ্ছন্নতার কথা মানছেন ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী সিপিএম কোঅর্ডিনেটর চয়ন ভট্টাচার্য। তাঁর অভিযোগ, “শুধু জঞ্জাল জমে থেকেই নয়, মেট্রোর স্তম্ভের জন্যও আদিগঙ্গার জলে দূষণ বাড়ছে। এলাকায় পানীয় জলের সমস্যাও রয়েছে। বিরোধী দলের কোঅর্ডিনেটরদের সঙ্গে সমন্বয় করে তৃণমূলের ওয়ার্ড কোঅর্ডিনেটরেরা কাজ করেন না। ফলে কাজের সমস্যা হয়।”
অপরিচ্ছন্নতার কারণে মশার চাষ হয় আদিগঙ্গা সংলগ্ন এলাকায়। ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডের খাল সংলগ্ন এলাকায় চায়ের দোকান মিতা সেনের। তিনি বলেন, “বিকেলে দোকান করব কী! মশার জন্য এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারি না। পুরসভা থেকে মাঝেমধ্যে ব্লিচিং ছড়িয়ে যায়। তাতে কি মশার হাত থেকে নিস্তার মেলে?’’ অভিযোগ আদিগঙ্গার ধার দিয়ে পিচের রাস্তা বিদ্যামন্দির রোড ঘিরেও। বাসিন্দা অরিজিৎ বিশ্বাস বলেন, “এই রাস্তাকে এখন বাইপাস রোডের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। এত সরু রাস্তার দু’দিকে ঘন জনবসতি। যে ভাবে এই রাস্তা দিয়ে তীব্র গতিতে গাড়ি যায়, যে কোনও দিন বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। স্পিড ব্রেকারের আবেদন জানিয়েও কাজ কিছু হয়নি।’’
বাঁশদ্রোণী বাজারের বাসিন্দা অনিমেষ পালের আক্ষেপ, “কোনও ফাঁকা জায়গা পেলেই সেটিকে জঞ্জাল ফেলার জায়গায় পরিণত করে দেওয়ার প্রবণতা এখানে যথেষ্ট।” ব্রহ্মপুর বাজারের ফলের ব্যবসায়ীদের আবার অভিযোগ, “ব্রহ্মপুরের বটতলা মোড় থেকে স্থানীয় ক্লাব পর্যন্ত জল জমে। রাস্তার ধারের দোকানগুলো জিনিস রাখতে রাখতে ফুটপাত দখল করে নিয়েছে। কেউ দেখার নেই!’’ জলের গুণগত মান এবং পরিমাণ খারাপ হওয়ায় বাসিন্দাদের বড় অংশকে জল কিনে খেতে হয় বলেও অভিযোগ।
এই বরোর ১০৩, ১০৪ নম্বর বা ১১০ নম্বর ওয়ার্ডের চেহারা আবার আলাদা। সেখানে অভাবও অন্য। ১১০ নম্বর ওয়ার্ডে পাটুলির অংশে চোখে পড়ে রাস্তার দু’ধারে পরিকল্পিত ঘরবাড়ি। ঝকঝকে রাস্তা। তবে সামান্য ভিতরে ঢুকতেই পাটুলির বরোদা অ্যাভিনিউয়ের বহুতলের মাঝের ফাঁকা জমিতে সেই জঞ্জালের স্তূপ। সেখানে জমে রয়েছে জলও। ‘‘কেন এই জঞ্জাল আর জমা জল পরিষ্কার হবে না?’’ প্রশ্ন তুলছেন বাসিন্দারা।
গরফা মেন রোড এবং যাদবপুর-সন্তোষপুরের সন্তোষপুর অ্যাভিনিউয়ের কিছুটা অংশ জুড়ে ১০৩ এবং ১০৪ নম্বর ওয়ার্ড। গরফা মেন রোডের শিবমন্দির বাজার এলাকার এক বাসিন্দা পলাশ প্রধান বলেন, “এলাকার বড় অংশ জুড়ে কোনও গণশৌচাগার নেই। পথচলতি মানুষের খুব অসুবিধা হয়।” যে দাবিকে সমর্থন করছেন ১০৩ নম্বরের কংগ্রেস প্রার্থী দেবজ্যোতি দাস। ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের কালিকাপুর, ইস্টার্ন পার্ক, সাউথ পার্ক এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ দাস বলছেন, “জলের চাপ এতই কম যে দোতলায় এক বালতি ভরতে ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। বর্ষা হলেই রাস্তায় হাঁটুজল জমে যায়। এ বছর বাড়ির ভিতরে পর্যন্ত জল ঢুকে গিয়েছিল।”
১১ নম্বর বরোর বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর, তৃণমূলের তারকেশ্বর চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘এই বরোয় ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা ছিল না। খোলা নর্দমার জন্য সমস্যা হত। এখন
ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরির কাজ চলছে। সেই কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ। সম্পূর্ণ হলে জল জমার সমস্যা মিটে যাবে। এলাকার ঘরে ঘরে মিষ্টি পানীয় জল পৌঁছে দিতে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি হয়েছে।’’ আর আদিগঙ্গা? সরাসরি উত্তর না দিলেও তাঁর প্রতিশ্রুতি, ‘‘এলাকার প্রতিটি খাল সংস্কার করা হচ্ছে। বৃষ্টি হলে জল জমার সমস্যা আর থাকবে না।’’
যা শুনে আদিগঙ্গার পাড়ে গুটিসুটি বসা এক বৃদ্ধ মুচকি হেসে বলছেন, ‘‘সে- ই প্রতিশ্রুতি। ভোট মিটলেই সবাই সব ভুলে যাবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy