উপায়: পাইপ ফুটো করে চলছে পানীয় জল নেওয়া। রিমাউন্ট রোডে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
তেষ্টা মেটাতেই হোক কিংবা বর্ষার বৃষ্টি— জল নিয়ে আতঙ্কে থাকেন এই অঞ্চলের গলি ও তস্য গলির বাসিন্দারা। পুরসভার কলের জলে ভাসে নোংরা। তাই কলকাতা শহরের বাসিন্দা হয়েও জল ফুটিয়ে খাওয়াই দস্তুর ছোট ছোট ঘরগুলির বাসিন্দাদের। সেই জল আবার মৃত্যুভয়ের কারণও। ভারী বৃষ্টিতে কোমর সমান জলে ডুবে যায় এলাকা। তাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অতীতে মৃত্যুও ঘটেছে। জল নিয়ে তাই বাসিন্দাদের আতঙ্ক কাটে না কিছুতেই।
উপরের ছবিটা কলকাতা পুরসভার ৯ নম্বর বরোর অধীন বন্দর এলাকার। একবালপুর রোড, একবালপুর লেন, মোমিনপুর, ছোট বাজারের মতো এলাকা ঘুরে জানা গেল, জল নিয়ে বিভিন্ন ভাবে আতঙ্ক কাজ করে মানুষের মধ্যে। তাঁদের সব চেয়ে বেশি ভয় বর্ষাকে। ভারী বৃষ্টিতে প্রায় এক কোমর জল দাঁড়িয়ে যায় ভূকৈলাস রোড ও সংলগ্ন এলাকায়। অভিযোগ, নিকাশি ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। জমা জল ভেঙে চলতে গিয়ে গত বছর একই দিনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাড়ার দুই যুবকের মৃত্যুর ঘটনার আতঙ্ক এখনও টাটকা স্থানীয়দের মনে।
ওই দু’জনের মধ্যে এক জন, রাজা মল্লিক ছিলেন একবালপুর লেন বস্তির বাসিন্দা। তাঁর এক ভাই কার্তিক মল্লিক বললেন, ‘‘কাকিমার জন্য দাদা চা ও খাবার কিনতে বেরিয়েছিল। গোটা রাস্তা জলে থইথই। বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ছাতা ছুঁয়ে গিয়েছিল দাদার। তাতেই ও জলের মধ্যে লুটিয়ে পড়ে।’’
জল জমার একাধিক অভিযোগ শোনা গেল বন্দর এলাকার ৭৫, ৭৬, ৭৮, ৭৯ এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ডেও। স্থানীয়েরা জানালেন, ভূকৈলাস রোড, কোল বার্থ রোড, ফ্যান্সি মার্কেট এলাকা, হুসেন শাহ রোড, গড়াগাছা, হুগলি জুটমিল, ব্রেস ব্রিজের কাছে ইন্দিরা পল্লি-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের বড় মাথাব্যথার কারণ এই সমস্যা। এর সঙ্গে কোথাও কোথাও ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার জাঁকিয়ে বসা তো আছেই। ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম, হেস্টিংস, মুন্সিগঞ্জ, ওয়াটগঞ্জের মতো এলাকা নিয়ে তৈরি ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের দাবি, তাঁরা কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে থাকেন। ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডে থানা এবং সরকারি দফতরে বর্ষায় ইট পেতে টেবিল-চেয়ার উঁচু করে কাজ করার ছবিও দেখা গিয়েছে। যদিও বিদায়ী কোঅর্ডিনেটরের দাবি, সম্প্রতি মাইকেল দত্ত স্ট্রিটে ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ পাম্পিং স্টেশন তৈরির পরে নিকাশির সমস্যা মিটেছে।
জল-আতঙ্ক যদি হয় মুদ্রার একটি পিঠ, অন্য পিঠে রয়েছে এলাকা জুড়ে অপরিচ্ছন্নতার ছবি। এমনিতেই বন্দর এলাকায় পেল্লায় সব ট্রাকের চলাচলের কারণে ধুলো ওড়ে বিস্তর। অবস্থা এমন যে, সত্য ডাক্তার রোডে গাছের পাতা পর্যন্ত ধূসর হয়ে গিয়েছে। ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভূকৈলাস মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখা গেল, সেটি ঝকঝক করছে। কিন্তু স্থানীয় কার্ল মার্ক্স সরণি জুড়ে ছড়িয়ে আছে আবর্জনা। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদায়ী কোঅর্ডিনেটর রাম পিয়ারি রামের কাছে এ নিয়ে জানিয়েও সমস্যা মেটেনি। রাম অবশ্য দাবি করেছেন, পানীয় জলের পাইপলাইনের কাজ হওয়ার দরুণ রাস্তাটি একটু অগোছালো হয়ে রয়েছে।
যদিও বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ফিরহাদ হাকিমের দাবি, নিকাশির সমস্যা সমাধানে কবিতীর্থ পাম্পিং স্টেশন চালু করা হয়েছে। হুসেন শাহ রোডেও একটি পাম্পিং স্টেশন তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘‘একটি ১৬ দফা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পরিকল্পিত পাম্পিং স্টেশনটি রয়েছে। তবে সর্বত্র পানীয় জলের সমস্যা নেই। বস্তি অঞ্চলে কোথাও বেআইনি নির্মাণ হওয়ায় সংলগ্ন এলাকাগুলিতে জলের চাপ কমে যাচ্ছে। এই বিষয়টি আমাদের নজরে আছে।’’ এ দিকে, ফিরহাদ যে ওয়ার্ডে প্রার্থী, সেই ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই প্রার্থী পারমিতা দাশগুপ্তের অভিযোগ, পানীয় জলের সমস্যা না থাকলেও নিকাশির উন্নতির প্রয়োজন। তা ছাড়া, রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখার সমস্যাও রয়েছে।
পানীয় জল যে জীবনহানির কারণও হতে পারে, সেই অভিযোগ উঠেছিল ৯ নম্বর বরোরই ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে। গত মার্চে ওই ওয়ার্ডের শশিশেখর বসু রোড এবং সংলগ্ন এলাকায় পানীয় জল খেয়ে ৭০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘটনার পরপরই ওই ওয়ার্ডের শ্রমিক কলোনিতে মৃত্যু হয় এক পুরকর্মীর। মারা যায় একটি শিশুও। প্রাণ হারান আলিপুর মহিলা জেলের এক আবাসিকও। যদিও পুর প্রশাসকমণ্ডলীর সদস্যেরা দাবি করেছিলেন, ৭৩ ও ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের পানীয় জলের নমুনা পরীক্ষায় খারাপ কিছু পাওয়া যায়নি।
কিন্তু সেই ঘটনার আঁচ পড়েছে আসন্ন পুর ভোটে। পানীয় জলে দূষণ ঘটার অভিযোগ ওঠার পরে চাপের মুখে ৭৩ নম্বরের তৎকালীন কোঅর্ডিনেটর রতন মালাকার বলেছিলেন, ‘‘ডি এল খান রোডের একাংশে পানীয় জলের সঙ্গে নিকাশির জল মিশে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। সংক্রমণের শিকার হয়েছেন গোটা শশিশেখর বসু রোডের বাসিন্দারা। আমরা খবর পেয়েই জলে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়েছি।’’
ঘটনাচক্রে, সেই ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে এ বার তৃণমূল প্রার্থী করেছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভ্রাতৃবধূ কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রতন ওই ওয়ার্ড থেকে নির্দল হিসাবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। শুক্রবার তিনি তা প্রত্যাহার করেছেন। ‘জল পান’ করে অসুস্থতার অভিযোগ মেনে নেওয়ার জেরেই রতনকে আসন হারাতে হল কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ওয়ার্ডের অন্দরে। তোপ দাগছেন বিরোধীরাও। ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাম প্রার্থী মধুমিতা দাসের বক্তব্য, ‘‘সব সময়েই মানুষের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হয়।’’ কংগ্রেস প্রার্থী প্রবীর পালের সংযোজন, ‘‘ভয় দেখিয়ে মৃতদের পরিবারের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। আমরা ওঁদের বিচার পাইয়ে দেব।’’
অপরিষ্কার পানীয় জলের অভিযোগ উঠেছে ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডেও। সেখানকার ভূকৈলাস রোডের বানোয়ারি মাঠের কাছে একবালপুর লেনে একটি বস্তিতে গিয়ে দেখা গেল, ঘরের বারান্দায় স্টোভ জ্বালিয়ে জল ফোটানো হচ্ছে। পরিবারের গৃহিণীর কথায়, ‘‘বাচ্চা থেকে বড়, সবাই জল ফুটিয়েই খাই।’’
আবার মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্র ভবানীপুর বিধানসভার অধীন ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কয়েক পশলা বৃষ্টিতেই স্থানীয় নন্দন রোড, চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মতো রাস্তায় বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় থাকে না। সেই সঙ্গে উঠছে বস্তি ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগও। মধুসূদন কর্মকার নামে এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘উন্নয়নের বদলে বস্তি উচ্ছেদ করে সেই জায়গায় বহুতল তৈরি হচ্ছে। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ১০ দিন আগেও যে বস্তির ঘর ছিল, এখন সেই জায়গা ফাঁকা।’’ একই অভিযোগ এসেছে ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy