কিরণ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে দেশে-বিদেশে নানা অনুষ্ঠানের পরিসরে কিরণ মুখোপাধ্যায় বলতেই পারেন, তাঁর অভিজ্ঞতা একেবারেই অন্য রকম। রবীন্দ্রশতবর্ষে মুম্বইয়ে অভিনীত হয়েছিল ‘দাস পোস্টআমট্’। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নাটক ডাকঘরের জার্মান অনুবাদ। সেই নাটকে অমলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কিরণ। জার্মানির ছোট্ট শহর ল্যান্ডশাটে বসে কিরণ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন ছ’দশক আগেকার সেই অভিজ্ঞতার কথা।
সেই নাটকে কিরণের অভিনয়ের প্রেক্ষাপটটাও এক দীর্ঘ কাহিনি। যা নাটকের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আসলে কিরণের বাবা-মার জীবনের বিচিত্র উত্থানপতন তাঁকে ভারতে এনে ফেলেছিল। কিরণ কলকাতাতে জন্মাতেই পারতেন তাঁদের আলিপুরের বাড়িতে। ঘটনাচক্রে তা হয়নি। ১৯৪৭ সালে কলকাতার উত্তাল পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তাঁর বাবা-মা চলে যান ধানবাদে। কিরণের জ্যাঠামশাইয়ের কাছে। সেখানেই জন্ম তাঁর, ভারতের স্বাধীনতা লাভের তিন দিন আগে। পরে অবশ্য তাঁরা মুম্বইয়ে চলে যান। তাঁর ছোটবেলার পড়াশোনা মুম্বইয়ের বিখ্যাত ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন ক্যানন স্কুলে। বয়সে কিছুটা ছোট হলেও সেই স্কুলে তাঁর চেয়ে এক ক্লাস উঁচুতে পড়তেন সলমন রুশদি। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। শিবাজি পার্কের কাছে যে বাড়িতে থাকতেন তার আশপাশে বন্ধুরা ছিলে হিন্দিভাষী। হিন্দি শেখা তাদের কাছেই। বাবা ব্রজলালের পদবি মুখোপাধ্যায় হলেও বাংলা তাঁর শেখা হয়নি কোনও দিন। কারণ, বাড়ির ভাষা ছিল জার্মান। মা ইভামেরি জেলিটো বাংলা রপ্ত করতে পারেননি। আর, বাবা দীর্ঘ দিন জার্মানিতে থাকার সুবাদে ঝরঝরে জার্মান বলতে পারতেন। বলতেন কিরণও। আর সেটাই তাঁর ডাকঘর নাটকে অমলের ভূমিকা পাওয়ার অন্যতম কারণ। কিরণের কথায়, ‘‘আমার বয়স তখন ১৪। অমলের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বয়সটা একটু বেশিই। কিন্তু জার্মানভাষী কাউকেই পাওয়া যায়নি সে সময়। তাই শিকে ছিঁড়েছিল আমার ভাগ্যেই।’’
মুম্বইয়ের চার্চগেটের কাছে জয়হিন্দ কলেজে হয়েছিল সেই নাটক। কিরণের বেশ মনে আছে, নাটকের বাকি কুশীলবেরা ছিলেন জার্মান ভাষার শিক্ষার্থী। নাটকের এক একটা অংশের আলাদা আলাদা মহড়া হত। ভারতের জার্মান দূতাবাসের কর্মীরা সাহায্য করতেন। বিশেষত জার্মান উচ্চারণ যাতে নিখুঁত হয়, সে দিকে তাঁদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। ব্রেখটের দেশের মানুষজন নাটকের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল হবেন এতে আশ্চর্য কী! প্রতি রবিবার সকলকে নিয়ে গোটা নাটকের মহড়া হত। তাঁর জীবনে সেটাই ছিল প্রথম অভিনয়। পরে অবশ্য মঞ্চে আরও অভিনয় করেছেন। কিন্তু ভুলতে পারেননি ডাকঘরের কথা। সেই নাটকের লিফ্লেট থেকে শুরু করে বেশ কিছু আলোকচিত্র আজও সযত্নে রেখে দিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে। সে দিনের সেই নাটকের সঙ্গে একটা ইতিহাস সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে।
নাটকের উদ্যোক্তা ছিল ‘ইন্দো-জার্মান কালচারাল সোসাইটি’। হামবুর্গে এই সোসাইটির গোড়াপত্তন করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বলা যায়, সোসাইটির মুম্বই শাখার সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা এমআর ব্যাসের উদ্যোগেই নাটকের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। সেখানে কিরণের জায়গা করে নেওয়াও। নেতাজি জার্মানিতে বসবাসকালে তাঁর পার্সোনাল সেক্রেটারি ছিলেন ব্যাস। ব্যাসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিরণের বাবা ব্রজলাল। কিরণের কথায়, ‘‘আমার বাবা ব্রজলাল ছিলেন নেতাজির তৈরি করা জার্মানি আইএনএ ( ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি)-র প্রথমদিকের সদস্য। শুধু তা-ই নয়, হামবুর্গে সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৪২ সালে বাবাই প্রথম জনসমক্ষে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের জনগণমন। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত ভারতে ‘লর্ড সেভ দ্য কিং’ গাওয়াটা ছিল রীতি। বুঝতেই পারছেন আমাদের পরিবার রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষচন্দ্রের নানা অনুষঙ্গে ঘেরা।’’
অবশ্য তার কারণও আছে। তাঁর বাবা ব্রজলাল মুখোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র। ইতিহাস জড়িয়ে আছে তাঁর জীবনের প্রতি পদে। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন জার্মানি। কিন্তু ফিরতে পারেননি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়। আর্থিক সঙ্কটে পড়ে সেখানেই চাকরি খুঁজতে থাকেন ব্রজলাল। সে সময় জার্মান তরুণী ইভামেরি তাঁকে সাহায্য করেন। ব্রজলালের ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁর সঙ্গে। তত দিনে একটি টেক্সটাইল সংস্থায় কাজও পান। ইচ্ছা থাকলেও ইভামেরিকে বিয়ে করতে পারছিলেন না ব্রজলাল সে দেশের সরকারের আপত্তিতে। কোনও অ-জার্মান পুরুষ জার্মান মহিলাকে বিয়ে করবে, এটা তখন জার্মানি মেনে নিতে পারত না। শেষে সুভাষচন্দ্র সরকারের উপরমহলে কথা বলে বিয়ের পথ সুগম করেন। সুভাষচন্দ্রের এই অনুগ্রহের একাধিক কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন কিরণ। তাঁর বাবার জ্যাঠামশায় ছিলেন সুভাষের সহপাঠী। তা ছাড়া ইভামেরি ছিলেন এমিল শেঙ্কেলের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। হ্যাঁ, সুভাষচন্দ্রের স্ত্রী তথা অনিতার বসু পাফের মা।
বিদেশে থাকলেও দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ব্রজলাল। তরুণ ব্রজলাল ছিলেন জার্মানি থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে নিযুক্ত প্রথম সৈনিক। পরবর্তী কালে এর জন্য অশেষ দুঃখও ভোগ করতে হয়েছিল তাঁকে। গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছিল। পরবর্তী কালে জওহরলাল নেহরু এই ধরনের বহু ভারতীয়কে মুক্ত করে মুম্বইয়ে পুনর্বাসন দেওয়ার চেষ্টা করেন। ব্রজলাল-ইভামেরি দেশে ফিরে আসেন প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায়। নতুন জীবন শুরু করেন মুম্বইয়ে। কিরণের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ওই শহরে। পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে যান কিরণ এবং জীবিকার কারণে সেখানে থেকেও যান।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও জার্মানির যোগ কম নয়। সে দেশে গিয়েছিলেন তিন বার। ১৯২১, ১৯২৬ এবং ১৯৩০ সালে। সে ভাবে দেখতে গেলে একশো বছর পরে তেমনই একটা দশক এসে উপস্থিত হয়েছে। একটা পরিসর তৈরি হয়েছে তাঁর সফরগুলিকে ফিরে দেখার। কেননা, এই তিন সফরে তিনি আইনস্টাইনের মতো বিশ্ববিখ্যাত কিছু মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লেখেন ১৩টি গান, বেশ কিছু প্রবন্ধ।
কিরণ মনে করেন, বঙ্গজীবনের এই দুই ব্যক্তিত্বের প্রভাব তাঁর জীবনে অসীম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy