চেহারা নিয়ে অনেককে ব্যঙ্গবিদ্রুপ শুনতে হয় হামেশাই। ছবি: রণজিৎ নন্দী
—শরীর তো দিগন্ত। আকাশে ভাসিয়ে দিলেই হয়।
—আবার ভারী ভারী কথা বলছ ছোটকা! তোমাকে আমাদের সমস্যার কথা বলছি, আর তুমি সেটা নিয়ে মজা করছ? আসলে তোমাকে তো আর রোজ মোটু-মোটু শুনতে হয় না। পিকুর মতো প্যাংলাকাঠিও শুনতে হয় না।
—ওই দেখ। অহেতুক রাগছিস। জানিস দুর্যোধন ভীমকে মাকুন্দ বলে খেপাতেন। কারণ, ভীমের মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল না। শুধু তা-ই নয়, ভীমের হাঁটা নকল করে দুর্যোধন তাঁকে গরুও বলতেন! এটা আমি নয়, পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী বলেছেন। কিন্তু লাভ কী হল! শেষে কে জিতেছিল বল?
—সে যা-ই হোক। রোজ রোজ এই মোটু-প্যাংলা শুনতে শুনতে মন খারাপ হয়ে যায়। স্কুলে ঢুকলেই আমাদের দেখে ‘লরেল-হার্ডি’ বলে খেপায় অনেকে। কিন্তু ছোটকা, চেহারা তো কারও নিজের হাতে নেই। সেটা নিয়ে এ ভাবে খেপায় কেন বলো তো?
—মনোবিদেরা বলছেন, যারা খেপায় তাদের নিজেদের মধ্যেই কোথাও একটা অসন্তুষ্টি থাকে। তাই কে রোগা, কে মোটা, কে লম্বা, কে বেঁটে, এর গায়ে কেন লোম বেশি, তার মাথার চুল কেন ছোট— এ সব নিয়েই তারা অন্যদের পিছনে লাগে। মনোবিদ নীলাঞ্জনা স্যান্যাল যেমন বলছেন, ‘‘মানুষের নিজের ভিতরে হীনম্মন্যতা থাকলে সে তখন অন্যদের কোনও ত্রুটি, যেটা আসলে ত্রুটিই নয়, তাকে বড় করে দেখিয়ে আনন্দ পায়!’’ তাই যত ক্ষণ না হাসিঠাট্টার নামে, ক্রমাগত পিছনে লেগে অপর জনের আত্মবিশ্বাস ধসিয়ে দেওয়া যায়, তত ক্ষণ এটা চলতেই থাকে।
—ঠিকই। একই কথা শুনতে শুনতে আজকাল আর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না।
—ধুর বোকা! নাটকের দল নান্দীকারে কী হয় জানিস? নাটকের প্রশিক্ষণের সময়ে পুরুষ অভিনেতাদের বড় আয়নার সামনে জামা খুলে দাঁড়াতে বলা হয়। বলা হয়, নিজেকে দু’চোখ ভরে দ্যাখো। আমরা তো নিজেদের দিকেই অনেক সময়ে ভাল করে তাকিয়ে দেখি না। যদি নিজেকে দেখার পরে মনে হয়, আমি মোটা বা রোগা বা বেঁটে, তাতে কী হয়েছে? আমি নিজেকে নিয়ে দিব্যি আছি। তা হলে কোনও সমস্যা নেই। সোহিনী সেনগুপ্ত কী বলছেন শোন। বলছেন, ‘‘নিজেকে নিয়ে খুশি থাকাটা সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সকলে একই রকম দেখতে হবে, সকলের চেহারা একই রকম হলে, সেটা খুবই একঘেয়ে!’’
—একদম ঠিক বলেছেন উনি।
—আরও কী জানিস, এই ‘বডি শেমিং’ অনেক সময়েই বাণিজ্যিক জগৎ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন ধর, জিম করলে মেদ ঝরবে, ভুঁড়ির বদলে সিক্স প্যাক হবে, রোগা হলে স্বাস্থ্যবান হওয়ার ওষুধ আছে, আবার ফর্সা হওয়ার জন্য ক্রিম রয়েছে বাজারে। অর্থাৎ তুমি যা, সেটাকে পাল্টে দেওয়ার একটা পরিষেবা কেনো। বিপণন জগতের এই যে হাতছানি বা প্রভাব, এটাও ‘বডি শেমিং’কে নিয়ন্ত্রণ করছে। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুন্ডু কিন্তু সেটাই বলছেন। ফলে এর পরে কেউ তোদের পিছনে লাগলে পাল্টা প্রশ্ন করবি, ‘তোমরা এটা কেন বলছ? তোমরা কি জানো মানুষ হিসেবে আমি কী রকম? সেটা না জেনে শুধু চেহারা নিয়েই হাসিঠাট্টা করছ?’
—কিন্তু এগুলো তো ওরা শুনবে না ছোটকা। ওদের দলে তো অনেকে রয়েছে।
—আরে না শুনলেও তুই তোর কথাটুকু তো বলবি। আর দলে ভারী হলেই যে ঠিকটা বলা হয়, কে বলল?
—তা হলে বলছ এগুলোকে গুরুত্ব দেব না?
—নাহ! একেবারেই না। ওই যে বললাম, শরীর তো দিগন্ত। আকাশে ভাসিয়ে দিলেই হয়। আকাশে বিমান ওড়ে, পাখি ওড়ে। আবার চামচিকেও। ফলে তুই কোনটা দেখবি আর কোনটা শুনবি, তা তোর উপরেই নির্ভর করছে। শুধু বলব, অন্যের কথা না শুনে শরীরের গণ্ডি ভেঙে বাইরে এসে দাঁড়া। স্বাধীন হ! দেখবি, তখন কে কী বলল কিস্যু যায় আসে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy